রাজনীতি করেন না। থাকেন ঢাকার বাইরে। কালেভদ্রে ঢাকায় আসা হয় কাজে। ঢাকায় যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা তখন তিনি সিলেটের গ্রামের বাড়িতে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায় কর্মরত সংবাদকর্মী। তারপরও তার নামেই হয়েছে তিনটি মামলা। তাও বিস্ফোরক আইনে। যখন জানতে পারেন তখন তিনটি মামলার চার্জশিটও দেয়া হয়েছে আদালতে। ওয়ারেন্ট পেয়ে হতভম্ব শামীম আহমদ। হতভম্ব স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সবাই। ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি শামীম এখন হয়রানি থেকে মুক্তি পেতে ধর্ণা দিচ্ছেন ঢাকায়। এই তিন মামলার নেপথ্যে ভিন্ন কাহিনী। বালাগঞ্জ পুলিশের অপরাধ নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন শামীম। শামীমের দাবি, এতেই ক্ষুব্ধ হন বালাগঞ্জ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বর্তমানে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থানার ওসি আব্দুছ ছালেক। ওসি তাকে হুমকিও দিয়েছিলেন তখন।
সময়টা ২০১২ থেকে ২০১৩ সাল। বালাগঞ্জে ঘটে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড। এসব মামলাকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ঘুষ বাণিজ্যে মেতে ওঠেন। স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। থানার তৎকালীন ওসির সঙ্গে সখ্যতা ছিল মাদক ব্যবসায়ী-চোরাকারবারিদের। পুলিশ সদস্য থেকে থানার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মীও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন। হয়রানির শিকার সাধারণ মানুষের অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে ২০১৩ সালের ১০ ও ১১ই জুলাই এসব সংবাদ প্রকাশ হয়। শামীম আহমদ অভিযোগ করেন, শুরুতেই তৎকালীন ওসি আব্দুছ ছালেক ক্ষুব্ধ হয়ে থানার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মী আব্দুল করিমকে দিয়ে শামীমের বিরুদ্ধে একটি জিডি করেন। পরবর্তীতে ওই জিডির প্রেক্ষিতে একটি মামলাও রেকর্ড করেন ওসি। এখান থেকেই শুরু। পরবর্তীতে থানার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মী আব্দুল করিমের আত্মীয় তেরাব আলীকে বাদী করে মারধরের অভিযোগে একটি মামলা করেন।
ওই মামলায় শামীমের ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ পিতাসহ তার পরিবারের ৬ সদস্যকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর শুরু হয় পুলিশের তৎপরতা। ওই মামলাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই আসামি ধরতে মাঠে নামে পুলিশ। বাধ্য হয়ে বাড়িঘর ছাড়েন শামীমের পরিবারের সদস্যরা। পরবর্তী সময়ে আদালত মামলার বিচারকার্য না করে ওই মামলাগুলো স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে প্রেরণের আদেশ দেন। সর্বশেষ দু’টি মামলার অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলেও মামলা থেমে থাকেনি। নতুন করে আবারও মামলার আসামি হন শামীম। কিন্তু তখনো তিনি জানেন না তার বিরুদ্ধে সিলেটের বাইরেও মামলা হচ্ছে।
বালাগঞ্জ থানায় তখন ওসি আব্দুছ ছালেক নেই। থানা থেকে শামীমকে জানানো হয় তার নামে ওয়ারেন্ট রয়েছে। আদালতে হাজির হতে হবে। কিসের মামলা, কিসের ওয়ারেন্ট কিছুই বুঝতে পারেন না তিনি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ঢাকা মেট্টোপলিটনের চকবাজার থানায় ৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে তাকে। যখন জানতে পেরেছেন ততদিনে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে আদালতে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৯শে অক্টেবর একটি মামলা ও ৫ই নভেম্বর দায়ের করা দু’টি মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে শামীমের নাম দেয়া হয়। এতে ভূমিকা ছিল তৎকালীন উপ-পরিদর্শক ডেরিক স্টিফেনের। বালাগঞ্জ থানায় কর্মরত ছিলেন স্টিফেন। ২০১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ওসি ছালেকের ঘনিষ্ঠ এসআই ডেরিক স্টিফেন কূইয়া বালাগঞ্জ থানা থেকে ডিএমপি’র চক বাজার থানায় বদলি হন। শামীমের অভিযোগ, ছালেকের পরামর্শে স্টিফেনের মাধ্যমে ওই মামলাগুলোতে আসামি হিসেবে তার নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে ডেরিক স্টিফেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে বালাগঞ্জ থানার তৎকালীন সময়ে দায়িত্ব পালনকারী বর্তমানে শ্রীমঙ্গল থানার ওসি আব্দুছ ছালেক ওই সময়ে থানার পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও তার আত্মীয় কর্তৃক দায়েরকৃত মামলার বিষয়ে বলেন, হুম থানার ঝাড়ুদার ও তার আত্মীয় জিডি ও মামলা করেছে। এতে আমার কোনো হাত ছিল না। তাছাড়া ডিএমপি’র চকবাজার থানার মামলার বিষয়ে তিনি অবগত না বলে জানান।
১৯০৮ সালের বিস্ফোরক উপাদানাবলী আইন (সংশোধনী ২০০২) এর ৫/৬ ধারায় চকবাজার থানার মামলাগুলো রেকর্ড করা হয়। দু’টি মামলার মধ্যে এজাহারে একটির ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে রাজধানীর চকবাজারের উর্দ্দু রোডের নাভানা টাওয়ারের সামনে। অপর দু’টি মামলার ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে ইমামগঞ্জ পানঘাটের আতিক ট্রান্সর্পোট এজেন্সির সামনে ও লালবাগ চৌরাস্তার ৫২ হরনাথ ঘোষ রোডের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বুথের সামনে। চকবাজার থানায় দায়ের করা মামলাগুলোতে ঘটনা সংঘটিত হওয়ার যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে ওই সময়ে শামীম ছিলেন সিলেটের বালাগঞ্জে। এ বিষয়ে তিনি জানান, তখন পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। পত্রিকায় ই-মেইলে সংবাদ পাঠাচ্ছিলেন। ওই সময়ে তিনি কোন স্থানে বসে ই-মেইলে সংবাদ পাঠিয়েছেন, তার অবস্থান কোথায় ছিল তা প্রযুক্তির সহায়তায় বের করতে পারতেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। কিন্তু তা তদন্ত না করেই আদালতে চার্জশিট দিয়েছেন।
ওই সময়ে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন আজিজুল হক। বিভিন্ন সময়ে ৩টি মামলার তদন্ত করেছেন, এসআই শরীফ ইবনে আলম, এসআই মো. শাখাওয়াত হোসেন, এসআই অনাথ মিত্র, এসআই শেখ মো. বেলায়েত ও এসআই মো. জাহাঙ্গীর আলম। বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে দায়েরকৃত এসব মামলায় শামীমকে আসামি করায় হতভম্ব বালাগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের বালাগঞ্জ উপজেলার সভাপতি মোস্তাকুর রহমান মফুর ও সাধারণ সম্পাদক মো. আনহার মিয়া জানান, শামীম রাজনীতি করে না। সাংবাদিকতা শুরুর আগে ছাত্রলীগ করতো। পুলিশের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখার কারণে তাকে ঢাকায় নাশকতার মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সুষ্ঠুু তদন্ত সাপেক্ষে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা। হয়রানিমূলক এসব মামলা থেকে মুক্তি পেতে গত বছরের ২২শে নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ও ২৮শে নভেম্বর পুলিশের আইজিপি’স কমপ্লেইন সেলে লিখিত অভিযোগ করেছেন শামীম। ভুক্তভোগী শামীম আহমদ দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক সিলেট মিরর’র বালাগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি। এ বিষয়ে ডিএমপি’র লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, বিষয়টি অনেক আগের, আমার জানা নেই। যেহেতু এ বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে, আশা করছি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ পাবে।