প্রশ্ন: ইসলামের দৃষ্টিতে সুন্দর চরিত্রের মর্যাদা কি এবং সুন্দর চরিত্র বলতে কী বুঝায়? চরিত্র সুন্দর করার জন্য কী কী বিষয় থাকা জরুরি এবং আমরা কিভাবে সুন্দর চরিত্রে চরিত্রবান হতে পারব?
উত্তর:
নিম্নে হাদিস থেকে সুন্দর চরিত্রের মর্যাদা, পূর্বসূরিদের থেকে এর সংজ্ঞা ও চরিত্রের কতিপয় মৌলিক উপাদান এবং কিভাবে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হতে পারব তার উপায় সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হল:
◈◈ উত্তম চরিত্রের মর্যাদা সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস:
➧ ১. ঈমানের পূর্ণতা উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে ঘটে থাকে:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
أكملُ المؤمنين إيمانًا أحسنُهم خُلقًا
“মুমিনদের মাঝে পূর্ণ ইমানদার সেই ব্যক্তি যে তাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।” [তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুর রিযা, অনুচ্ছেদ: স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার, সিলসিলা সাহীহা, হা/২৮৪।]
➧ ২. উত্তম চরিত্রের কারণে বান্দা প্রভুর জন্য বিনয় অবনতভাবে ইবাদত কারীদের মর্যাদা লাভ করে থাকে:
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন,
إِنَّ الُمؤْمِنَ لَيُدْركُ بِحُسنِ خُلُقِه درَجةَ الصائمِ القَائمِ
“নিঃসন্দেহে মুমিন ব্যক্তি তার সর্বোত্তম চরিত্রের মাধ্যমে সিয়াম পালনকারী, রাত জেগে ইবাদত কারীর মর্যাদায় ভূষিত হয়”। [আবু দাউদ, অধ্যায়: কিতাবুল আদাব, অনুচ্ছেদ: উত্তম চরিত্র, সহীহ আল জামে, হা/ ১- ১৯৩২।
➧ ৩. উত্তম চরিত্র কিয়ামত দিবসে বান্দার আমলের পাল্লাকে ভারী করে দিবে:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَا مِنْ شَيءٍ أَثْقَلُ في ميزَانِ المُؤمِنِ يَومَ القِيامة مِنْ حُسْنِ الخُلُقِ
“কিয়ামত দিবসে উত্তম চরিত্রের চাইতে ভারী কোন কিছু পাল্লায় রাখা হবে না।” [তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুল বির ওয়াস সিলাহ, অনুচ্ছেদ: উত্তম চরিত্র, সহীহুল জামে, হাদিস নং- ২/ ৫৭২১।]
➧ ৪. যে বিষয়টি অধিক হারে মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে তা হল, এই উত্তম চরিত্র:
سُئِلَ رسولُ اللَّه ﷺ عَنْ أَكثرِ مَا يُدْخِلُ النَّاسَ الجَنَّةَ، قَالَ: تَقْوى اللَّهِ وَحُسْنُ الخُلُق
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে প্রশ্ন করা হল, সর্বাধিক কোন বিষয়টি মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে? তিনি বললেন, “আল্লাহ ভীতি এবং উত্তম চরিত্র।” [তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুল আদাব, অনুচ্ছেদ: উত্তম চরিত্র, ইবনে মাজাহ, অধ্যায়: কিতাবুয যুহুদ, অনুচ্ছেদ: পাপ কাজের আলোচনা ও সিলসিলা সাহীহা, হা/৯২৭]
◈◈ পূর্বসূরিদের থেকে উত্তম চরিত্রের ব্যাখ্যা:
এ প্রসঙ্গে হাফেজ ইবনে রজব পূর্বসূরি বিদ্বানদের অনেক উক্তি উল্লেখ করেছেন। নিম্নে কয়েকটি পেশ করা হল:
◍ ক) হাসান বাসরি রহঃ বলেন, “উত্তম চরিত্র হল, আতিথেয়তা, দানশীলতা এবং ধৈর্যাবলম্বন।”
◍ খ) ইবনুল মুবারক রহঃ বলেন, “উত্তম চরিত্র হল, মানুষের সামনে প্রফুল্ল বদনে থাকা, সৎ উপদেশ দেয়া এবং কাউকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা।”
◍ গ) ইমাম আহমদ রহঃ বলেন, “উত্তম চরিত্র হচ্ছে, তুমি অযথা ক্রুদ্ধ হবেনা এবং করো প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ রাখবে না।”
◍ ঘ) অপর কোন বিদ্বান বলেছেন, “উত্তম চরিত্র বা সদাচার হল, আল্লাহর জন্য ক্রোধ সংবরণ করা। পাপী এবং বিদআতি ব্যতীত সকল ধরণের মানুষের সামনে হাস্যোজ্জ্বল ভাব প্রকাশ করা, ভুলত্রুটিতে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে শিক্ষা দেয়া বা তাদের উপর দণ্ডবিধি কায়েমের উদ্দেশ্য ব্যতীত তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া। প্রত্যেক মুসলমান এবং চুক্তিতে আবদ্ধ অমুসলমানদেরকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা। তবে অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং সীমালঙ্ঘন ব্যতীত মাজলুমের অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।” [জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃষ্ঠা নং ১৮২]
মূলত: উপরোল্লিখিত প্রত্যেকটি মন্তব্যই ‘উত্তম চরিত্র’ বা সদাচারের অন্তর্গত।
◈◈ আমরা কিভাবে উত্তম চরিত্রের গুণে গুণান্বিত হবো?
➧ আমরা তখনই সদাচার ও উত্তম চরিত্রে সৌন্দর্যে বিকশিত হতে পারব যখন আমরা সকল নবী-রসূলের সরদার, বিশ্বনবী মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পদাঙ্ক অনুসরণ করবো। কেননা তিনিই এই বিষয়টিকে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেন,
وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ
“আর অবশ্যই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা কলম: ৪) সুতরাং এ ক্ষেত্রে তিনিই হলেন সর্বোত্তম আদর্শ ও অনুকরণীয়। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَة
“নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনীতে রয়েছে সর্বোত্তম নমুনা বা আদর্শ।” (সূরা আহযাব: ২১)
অতএব, মুসলিম ব্যক্তির উপর আবশ্যক হল, সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করবে এবং সে সম্পর্কে গবেষণা করবে, তাঁর প্রতিপালকের সাথে তাঁর কিরূপ সম্পর্ক ছিল? কেমন ছিল আচরণ মানুষের সাথে? কিরূপ ব্যবহার করতেন পরিবারের সদস্যদের সাথে? তাঁর সাথী সাহাবীদের সাথে কিভাবে চলাফেরা করতেন? অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে কিরূপ আচরণ করতেন?
➧ এ ছাড়া সদ্যগুণ অর্জনের আরও পন্থা হল, পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী পরহেজগার ও চরিত্রবান ব্যক্তিদের সংস্পর্শ লাভের চেষ্টা করা, তাদের বৈঠকে বসা। কেননা একজন মানুষ অন্য জনের সংস্পর্শে আসলে তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
حديث (الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ
“ব্যক্তি তার বন্ধুর ধর্ম বা রীতি -নীতির অনুসারী হয়। সুতরাং তোমরা দেখে নাও কার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে”।
[আবু দাউদ, অধ্যায়: কিতাবুল আদাব, অনুচ্ছেদ: যার সাথে বৈঠকে বসার আদেশ দেয়া হবে। তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুয যুহুদ, অনুচ্ছেদ: ন্যায় ভাবে সম্পদ অর্জন। সহীহুল জামে, হা/৩৫৪৫]
অতএব প্রতিটি মুসলিমের উপর অপরিহার্য হচ্ছে, সচ্চরিত্র বান লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করা এবং অসৎ ও খারাপ চরিত্র সম্পন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গ ত্যাগ করা।
আরও পড়ুন: উন্নত চারিত্র সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র মুখনিঃসৃত একগুচ্ছ মনি-মুক্তা
https://www.facebook.com/Guidance2TheRightPath/posts/901927846893428
▬▬▬❖❖❖▬▬▬
উত্তর প্রদান:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।