সরকারি হাসপাতালের হিসাবরক্ষক তিনি। সবমিলিয়ে ২৬-২৭ হাজার টাকা বেতন পান। অথচ থাকেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। গড়েছেন আরো একাধিক ফ্ল্যাট। রয়েছে প্লট, দোকান। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়িও আছে। তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালের হিসাবরক্ষক জাকির হোসেন। সরকারি চাকরি পেয়ে রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। জাকিরের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) টেবিলেও জমা পড়েছে।
মাত্র আট বছরের চাকরি জীবনে জাকিরের কোটিপতি হওয়ার বিষয়টি রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হিসাব রক্ষক পদ হলেও সর্বক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেন তিনি। কাউকে তোয়াক্কা না করেই আধিপত্য বিস্তার করে আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন জাকির। জানা যায়, টেন্ডার বাগিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অবৈধ অর্থ আয়ের অন্যতম পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। একাধিক অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে টেন্ডার করিয়ে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ রয়েছে জাকিরের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে টেন্ডারবাজির সঙ্গে হিসাবরক্ষক ছাড়াও আরো কয়েকজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারি জড়িত।
২০১২ সালে ১৪ই জুন হাসপাতালটির হিসাবরক্ষক হিসেবে যোগ দেন জাকির। তার বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায়। শ্রমজীবী বাবার সন্তান হিসেবে চাকরিতে যোগদানের আগে কিছুই ছিল না জাকিরের। কিন্তু নিউরোসায়েন্সে হিসাবরক্ষক পদে যোগ দিয়েই ভাগ্য খুলে যায় তার। মাত্র আট বছরেই ঢাকায় তিনটি ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে যান জাকির। রাজধানীর কল্যাণপুরের মাদরাসা রোড, কমিশনার গলিতে ‘মাতৃছায়া কমপ্লেক্সে এপার্টমেন্টে’ একটি ফ্ল্যাট রয়েছে এই হিসাবরক্ষকের। ১৩৫০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের মূল্য কোটি টাকা। একই এলাকায় ৫৬/৯ নং দাগে আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে জাকিরের। যা তার এক আত্মীয়ের নামে কেনা। এই ফ্ল্যাটের বাজার মূল্য আশি লাখ টাকার বেশি। কল্যানপুরেই রোজ গার্ডেন এপার্টমেন্টে আরেকটি ফ্ল্যাট কেনেন জাকির। এটিও প্রায় কোটি টাকা দাম। তিনটি ফ্ল্যাট ছাড়াও রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় আড়াই কাঠা পরিমাণের প্লট রয়েছে জাকিরের। যার বর্তমান বাজার মূল্য এক কোটি টাকা। হিসাব রক্ষক জাকিরের অবৈধ সম্পদের গল্প এখানেই শেষ নয়। কিছুদিন আগেই ঢাকার অদূরে সাভারের স্বপ্নপুর আবাসিক এলাকায় তেত্রিশ শতাংশের একটি প্লট কিনেছেন বলে অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে। এই প্লটটি ২ কোটি টাকা দিয়ে তিনি কেনেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও ঢাকার পশ্চিম আগারগাঁওয়ে একটি হার্ডওয়্যার দোকানও রয়েছে জাকিরের। অনুসন্ধানে জানা যায়, গ্রীন হার্ডওয়্যার নামের এই দোকানটি তার বাবা বশির শিকদার পরিচালনা করেন।
জাকিরের সম্পদের তালিকায় আরো রয়েছে তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি। এর মধ্যে একটি নোয়াহ, একটি হায়েস ও একটি এলিয়ন কার। দুর্নীতির অর্থে কেনা এই গাড়ির মালিকানায় তার নাম রাখেননি জাকির। গাড়িগুলো তার বড় বোন বিলকিস আক্তার ও তার স্বামীর নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বহুদিনের। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনেও চলছে অনুসন্ধান। অবশ্য একই অভিযোগে জাকিরকে দুদকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল আগেও। তবে সেসময় অজানা কারণে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান থেমে যায়। এদিকে দুদকের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগেও জমা পড়ে জাকিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ। গত বছর ১১ই ডিসেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব বরাবর জাকিরের বিরুদ্ধে সেসব অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়। অভিযোগের প্রেক্ষিতে হিসেবে বিভাগের প্রশাসন-১ অধিশাখার যুগ্মসচিব শাহিনা খাতুন ১৮ই ডিসেম্বর নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের পরিচালক বরাবর মতামত প্রদানের জন্য চিঠি পাঠান। প্রায় এক বছর কেটে গেলেও নিউরো সায়েন্সের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পায়নি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। পরবর্তীতে বিভাগের উপসচিব জাকিয়া পারভীন জাকিরের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে মতামত প্রদানের জন্য চলতি বছরের ১১ই নভেম্বর আবারো চিঠি দেন। এ চিঠির বিষয়ে এখনও নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল কোনো বক্তব্য বা মতামত দেয়নি।
চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব জাকিয়া পারভীন মানবজমিনকে বলেন, জাকিরের বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো কোনো মতামত দেয়নি। পেলে জানা যাবে।
এদিকে জাকিরের বিষয়ে জানতে নিউরোসায়েন্সের উপপরিচালক ফারুক আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। অপরদিকে অভিযোগের ব্যাপারে জাকিরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।