Friday, December 6, 2024
No menu items!

আমাদের মুসলিমউম্মাহ ডট নিউজে পরিবেশিত সংবাদ মূলত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের সমাহার। পরিবেশিত সংবাদের সত্যায়ন এই স্বল্প সময়ে পরিসরে সম্ভব নয় বিধায় আমরা সৌজন্যতার সাথে আহরিত সংবাদ সহ পত্রিকার নাম লিপিবদ্ধ করেছি। পরবর্তীতে যদি উক্ত সংবাদ সংশ্লিষ্ট কোন সংশোধন আমরা পাই তবে সত্যতার নিরিখে সংশোধনটা প্রকাশ করবো। সম্পাদক

হোমসীরাতহাসান বিন আলী (রাঃ)

হাসান বিন আলী (রাঃ)

ভূমিকা : নবী করীম (ছাঃ)-এর দৌহিত্র, ইসলামের চতুর্থ খলীফা আলী (রাঃ) ও ফাতেমা (রাঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র হাসান (রাঃ) ছিলেন স্বীয় পিতা আলী (রাঃ)-এর পরে খেলাফতের দায়িত্ব পালনকারী ছাহাবী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ইবাদতগুযার, ন্যায়পরায়ণ ও মুত্তাক্বী-পরহেযগার এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবী। তাঁর জীবনী নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

নাম ও বংশ পরিচয় :

তাঁর নাম হাসান, উপনাম আবু মুহাম্মাদ, লকব বা উপাধি জান্নাতী যুবকদের সরদার (سَيِّدُ شَبَابِ أَهْلِ الجَنَّةِ), নিসবতী নাম আল-হাশেমী আল-ক্বারাশী।[1] তাঁর পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে, হাসান ইবনু আলী ইবনে আবী তালিব ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম ইবনে আব্দে মানাফ।[2] তিনি ফাতিমা (রাঃ)-এর পুত্র এবং খাদীজা (রাঃ) ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দৌহিত্র।[3]

জন্ম ও শৈশব :

বিশুদ্ধ মতে, হাসান (রাঃ) তৃতীয় হিজরীর ১৫ই রামাযান মদীনা মুনাওয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন।[4] কেউ কেউ তাঁর জন্ম শা‘বান মাসে বা তার পরে হয়েছে বলে উল্লেখ করলেও তা সঠিক নয়। আহমাদ ইবনু আব্দুর রহমান আল-বারক্বী ও ইবনু সা‘দ বলেন, হাসান (রাঃ) তৃতীয় হিজরীর মধ্য রামাযানে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন।[5] আববাস (রাঃ)-এর স্ত্রী হাসান (রাঃ)-কে দুধ পান করান। উম্মুল ফযল লুবাবা বিনতুল হারেছ আল-হিলালিয়া (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি স্বপ্নে আপনার দেহের কোন একটি অঙ্গ আমার ঘরে দেখতে পেলাম। তিনি বলেন, তুমি ভালোই দেখেছ। ফাতেমা একটি সন্তান প্রসব করবে এবং তুমি তাকে দুধ পান করাবে। অতএব ফাতেমা (রাঃ) হাসান (রাঃ)-কে প্রসব করেন এবং তিনি তাকে কুছাম-এর ভাগের দুধ পান করান’।[6]

নামকরণ ও আক্বীক্বা :

হাসান (রাঃ)-এর নামকরণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, আলী (রাঃ) বলেছেন, যখন হাসানের জন্ম হ’ল আমি তার নাম রাখলাম, হারব (অর্থ- যুদ্ধ)। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এসে বললেন, আমার নাতিকে দেখাও। তোমরা ওর কি নাম রেখেছ? আমি বললাম, হারব। তিনি বললেন, না, বরং ওর নাম হাসান’।[7]

রাসূল (ছাঃ) হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে একটি করে দুম্বা আক্বীক্বা করেন। ইবনু আববাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَقَّ عَنِ الْحَسَنِ، وَالْحُسَيْنِ كَبْشًا كَبْشًا ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে একটি করে দুম্বা আক্বীক্বা করেছেন।[8] অতঃপর তিনি ফাতেমা (রাঃ)-কে বলেন,يَا فَاطِمَةُ، احْلِقِي رَأْسَهُ، وَتَصَدَّقِي بِزِنَةِ شَعْرِهِ فِضَّةً ‘হে ফাতেমা! তার মাথা মুন্ডন করে দাও এবং তার চুলের ওযনের সমপরিমাণ রূপা দান কর। তদনুযায়ী আমি তার চুল ওযন করলাম। তার ওযন এক দিরহাম বা তার কাছাকাছি হয়’।[9]

শিক্ষাদীক্ষা ও হাদীছ বর্ণনা :

রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুকালে হাসান (রাঃ)-এর বয়স ছিল সাড়ে ৭ বৎসর। তিনি শৈশবে নবী করীম (ছাঃ)-এর সান্নিধ্য প্রাপ্ত খাতুনে জান্নাত ফাতিমা (রাঃ)-এর সার্বিক তত্ত্বাবধান ও আলী (রাঃ)-এর নিবিড় পরিচর্যায় ইলমে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি স্বীয় নানা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে কিছু হাদীছ মুখস্থ করেন। আর পিতা আলী (রাঃ) ও মাতা ফাতেমা (রাঃ) থেকে হাদীছ শেখেন। তাঁর থেকে তার পুত্র হাসান ইবনু হাসান, সুওয়াইদ ইবনু গাফলাহ, আবুল হাওরা আস-সা‘দী, শা‘বী, হুবায়রাহ ইবনু ইয়ারীম, আছবাগ ইবনু নাবাতাহ, আল-মুসাইয়িব ইবনু নাখবাহ প্রমুখ হাদীছ বর্ণনা করেন।[10] হাদীছ গ্রন্থগুলোতে তাঁর বর্ণিত কিছু হাদীছ পাওয়া যায়। বাকী ইবনু মাখলাদ স্বীয় মুসনাদে হাসান (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-এর ১৩টি হাদীছ উল্লেখ করেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) স্বীয় মুসনাদে হাসান (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত ১০টি হাদীছ উল্লেখ করেন। আর সুনানে আরবা‘আতে তাঁর থেকে বর্ণিত ৬টি হাদীছ উল্লেখিত হয়েছে।[11]

রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক প্রশিক্ষণ :

হাসান (রাঃ) শৈশবে বিভিন্ন বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) থেকে সরাসরি প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হাসান ইবনু আলী (রাঃ) ছাদাক্বার একটি খেজুর হাতে নিয়ে তা মুখে দিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘কাখ-কাখ’ শব্দ দ্বারা ইংগিত করে বললেন, ارْمِ بِهَا، أَمَا عَلِمْتَ أَنَّا لَا نَأْكُلُ الصَّدَقَةَ؟ এটা ফেলে দাও। তুমি কি জান না আমরা ছাদাক্বা খাই না’?[12]

দৈহিক গঠন :

হাসান (রাঃ) ছিলেন সাদা রক্তিমাভ সুন্দর চেহারার অধিকারী। তার ছিল কালো ডাগর দু’টি চোখ, নরম ও সমান চিবুক, লম্বা ঘন শ্মশ্রু, চাঁদির ন্যায় শুভ্র ও প্রশস্ত কাঁধ এবং কোঁকড়ানো চুল। তিনি অধিক দীর্ঘ ও অতি খাটো ছিলেন না বরং মধ্যম আকৃতির সুন্দর দেহের মানুষ ছিলেন। তিনি মেহেদী ও কাতাম দ্বারা খেযাব লাগাতেন।[13]

পারিবারিক জীবন :

হাসান (রাঃ) বহু বিবাহ করেছিলেন। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,وَكَانَ كَثِيرَ التَّزَوُّجِ، وَكَانَ لَا يُفَارِقُهُ أَرْبَعُ حَرَائِرَ، وَكَانَ مِطْلَاقًا مِصْدَاقًا، ‘তিনি অধিক বিবাহকারী ছিলেন। আর ৪ জন স্বাধীন স্ত্রী তার থেকে কখনও পৃথক হ’ত না। তিনি অধিক তালাক প্রদানকারী ও অধিক মোহরানা প্রদানকারী ছিলেন’।[14] বলা হয়ে থাকে, তিনি ৭০ জন মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন।[15] ঐতিহাসিকগণ তার স্ত্রীগণের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন। তারা হ’লেন, খাওলা আল-ফাযারিয়াহ, জা‘দাহ বিনতুল আশ‘আছ, আয়েশা আল-খাছ‘আমিয়াহ, উম্মু ইসহাক্ব বিনতু ত্বলহা বিনতে ওবায়দুল্লাহ আত-তামীমী, উম্মু বাশীর বিনতু আবী মাসঊদ আনছারী, হিন্দ বিনতু আব্দুর রহমান ইবনে আবী বকর, উম্মু আব্দুল্লাহ বিনতুশ শালীল ইবনে আব্দুল্লাহ প্রমুখ।[16]

হাসান বিন আলী (রাঃ)-এর ১৫ জন পুত্র এবং ৮জন কন্যা সন্তান ছিল।[17] তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম হচ্ছে- হাসান, যায়েদ, ত্বালহা, ক্বাসেম, আবুবকর, আব্দুল্লাহ [এরা সবাই হোসাইন (রাঃ)-এর সাথে কারবালায় শহীদ হন], আমর, আব্দুর রহমান, হুসাইন, মুহাম্মাদ, ইয়া‘কূব, ইসমাঈল, হামযাহ, জা‘ফর, আক্বীল প্রমুখ।[18] 

হাসান (রাঃ)-এর মর্যাদা :

নবী করীম প্রিয় দৌহিত্র হাসানকে অত্যধিক ভালবাসতেন, পৃথিবীতে যার তুলনা বিরল। তার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করতেন। কখনও তিনি হাসানকে নিজের কাঁধে উঠাতেন। কখনও তাকে কোলে নিয়ে ছালাত আদায় করতেন। রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে হাসান (রাঃ)-এর অনন্য মর্যাদা ফুটে উঠেছে নিম্নোক্ত হাদীছ সমূহে।-

(ক) হাসান (রাঃ)-এর প্রতি রাসূল (ছাঃ)-এর মহববত ও অনুগ্রহ :

রাসূল (ছাঃ) স্বীয় দৌহিত্র হাসানকে প্রাণাধিক মহববত করতেন। যেমন নিম্নের হাদীছে এসেছে,

  1. عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ أَحَبَّ الْحَسَنَ وَالْحُسَيْنَ فَقَدْ أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَبْغَضَهُمَا فَقَدْ أَبْغَضَنِي،

১. আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি হাসান ও হুসায়নকে ভালোবাসে, সে আমাকেই ভালোবাসে এবং যে ব্যক্তি তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে আমার প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে’।[19]

২. শাদ্দাদ (রাঃ) বলেন, একদা যোহর অথবা আছরের ছালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি আমাদের মাঝে বের হ’লেন। তাঁর কোলে ছিল হাসান অথবা হুসাইন। তিনি সামনে গিয়ে তাকে নিজের ডান পায়ের কাছে রাখলেন। অতঃপর তিনি তাকবীর দিয়ে ছালাত শুরু করলেন। ছালাত পড়তে পড়তে তিনি একটি সিজদাহ (অস্বাভাবিক) লম্বা করলেন। (ব্যাপার না বুঝে) আমি লোকের মাঝে মাথা তুলে ফেললাম। দেখলাম, তিনি সিজদাহ অবস্থায় আছেন, আর তাঁর পিঠে শিশুটি চড়ে বসে আছে! অতঃপর পুনরায় আমি সিজদায় ফিরে গেলাম। আল্লাহর আসূল (ছাঃ) ছালাত শেষ করলে লোকেরা তাঁকে বলল, হে আল্লাহর আসূল (ছাঃ)! আপনি ছালাত পড়তে পড়তে একটি সিজদাহ (অধিক) লম্বা করলেন। এর ফলে আমরা ধারণা করলাম যে, কিছু হয়তো ঘটল অথবা আপনার উপর অহী অবতীর্ণ হচ্ছে। তিনি বললেন, এ সবের কোনটাই নয়। আসলে (ব্যাপার হ’ল), আমার বেটা (নাতি) আমাকে সওয়ারী বানিয়ে নিয়েছিল। তাই তার মন ভরে না দেওয়া পর্যন্ত (উঠার জন্য) তাড়াতাড়ি করাটাকে আমি অপসন্দ করলাম’।[20]

৩. আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) ছালাত পড়তেন, আর সিজদাহ অবস্থায় হাসান ও হুসাইন তাঁর পিঠে চড়ে বসত। লোকেরা তাদেরকে এমন করতে নিষেধ করলে তিনি ইশারায় বলতেন, ওদেরকে (নিজের অবস্থায়) ছেড়ে দাও। অতঃপর ছালাত শেষ করলে তাদের উভয়কে কোলে বসিয়ে বলতেন, যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে যেন এদেরকে ভালোবাসে’।[21]

  1. عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ كُنْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِى سُوقٍ مِنْ أَسْوَاقِ الْمَدِينَةِ فَانْصَرَفَ فَانْصَرَفْتُ فَقَالَ أَيْنَ لُكَعُ ثَلاَثًا ادْعُ الْحَسَنَ بْنَ عَلِىٍّ. فَقَامَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِىٍّ يَمْشِى وَفِى عُنُقِهِ السِّخَابُ، فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِيَدِهِ هَكَذَا، فَقَالَ الْحَسَنُ بِيَدِهِ، هَكَذَا فَالْتَزَمَهُ فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنِّى أُحِبُّهُ، فَأَحِبَّهُ، وَأَحِبَّ مَنْ يُحِبُّهُ.

৪. আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে মদীনার কোন এক বাজারে ছিলাম। তিনি (বাজার থেকে) ফিরলেন। আমিও ফিরলাম। তিনি বললেন, ছোট শিশুটি কোথায়? এ কথা তিনবার বললেন। হাসান ইবনু আলীকে ডাক। দেখা গেল হাসান ইবনু আলী হেঁটে চলেছে। তাঁর গলায় ছিল মালা। নবী করীম (ছাঃ) এভাবে তাঁর হাত উঠালেন। হাসানও এভাবে নিজের হাত উঠালো। তারপর তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! আমি একে ভালবাসি, আপনিও তাকে ভালবাসুন এবং যে ব্যক্তি তাকে ভালবাসে, তাকেও আপনি ভালবাসুন’। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এ কথা বলার পর থেকে হাসান ইবনু আলীর চেয়ে অন্য কেউ আমার কাছে অধিকতর প্রিয় হয়নি।[22]

  1. عن أسامة بن زيد قال: كَانَ رسول الله صلى الله عليه وسلم يَأْخُذُنِيْ فَيُقْعِدُنِيْ عَلَى فَخِذِهِ وَيُقْعِدُ الْحَسَنَ بْنَ عَلِي عَلَى فَخِذِهِ الأُخْرَى ثُمَّ يَقُوْلُ: اَللَّهُمَّ إِنِّي أَرْحَمُهُمَا فَارْحِمْهُمَا،

৫. উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে ধরে তাঁর উরুর উপরে বসালেন এবং হাসান বিন আলীকে অন্য উরুর উপরে বসালেন। অতঃপর বললেন, হে আল্লাহ! আমি এদের দু’জনের প্রতি দয়ার্দ্র। সুতরাং তুমি তাদের উভয়ের উপরে দয়া কর’।[23]

  1. عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ الْأَقْرَعَ بْنَ حَابِسٍ، أَبْصَرَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يُقَبِّلُ حُسَيْنًا فَقَالَ: إِنَّ لِي عَشَرَةً مِنَ الْوَلَدِ مَا فَعَلْتُ هَذَا بِوَاحِدٍ مِنْهُمْ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ لَا يَرْحَمُ لَا يُرْحَمُ

৬. আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আক্বরা বিন হাবিস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখলেন যে, তিনি হাসানকে চুমু খাচ্ছেন। ইবনু আবী ওমর তার বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি হাসান অথবা হুসাইনকে চুমু খেয়েছেন। আক্বরা (রাঃ) বলেন, আমার দশটি সন্তান আছে। কিন্তু আমি তাদের কাউকে কখনো চুমু দেইনি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি দয়া করে না সে দয়াপ্রাপ্ত হয় না’।[24]

৭. ইয়ালা আল-আমেরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হাসান ও হোসাইন (রাঃ) দৌড়াতে দৌড়াতে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আসলেন। তিনি তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, সন্তান কৃপণতা ও কাপুরুষতা সৃষ্টিকারী’।[25]

  1. عَنْ مُعَاوِيَةَ قَالَ َأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَمُصُّ لِسَانَهُ أَوْ قَالَ شَفَتَهُ يَعْنِى الْحَسَنَ بْنَ عَلِىٍّ صَلَوَاتُ اللهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَنْ يُعَذَّبَ لِسَانٌ أَوْ شَفَتَانِ مَصَّهُمَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم.

৮. মু‘আবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখলাম তার জিহবা অথবা ঠোট চুষছেন। অর্থাৎ হাসান বিন আলী (রাঃ)-এর। নিশ্চয়ই যে জিহবা অথবা ঠোটদ্বয় রাসূল (ছাঃ) চুষছেন তাকে কখনও শাস্তি দেওয়া হবে না’।[26]

  1. عَنْ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: بَيْنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْمِنْبَرِ يَخْطُبُ إِذْ أَقْبَلَ الْحَسَنُ، وَالْحُسَيْنُ عَلَيْهِمَا السَّلَامُ عَلَيْهِمَا قَمِيصَانِ أَحْمَرَانِ يَمْشِيَانِ وَيَعْثُرَانِ، فَنَزَلَ وَحَمَلَهُمَا، فَقَالَ: صَدَقَ اللهُ: {إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ} [التغابن: 15] رَأَيْتُ هَذَيْنِ يَمْشِيَانِ وَيَعْثُرَانِ فِي قَمِيصَيْهِمَا فَلَمْ أَصْبِرْ حَتَّى نَزَلْتُ فَحَمَلْتُهُمَا،

৯. বুরায়দা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে খুৎবা দিচ্ছিলেন, ইত্যবসরে হাসান ও হুসায়ন (রাঃ) আসলেন। তাদের পরিধানে দু’টি লাল জামা ছিল। তাঁরা চলছিলেন এবং জামায় আটকে আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। তিনি নীচে নেমে আসলেন এবং উভয়কে উঠিয়ে নিলেন আর বললেন, আল্লাহ তা‘আলা সত্যই বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের সস্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি পরীক্ষা স্বরূপ’ (তাগাবুন ৬৪/১৫); আমি এদের দেখলাম যে, এরা চলছিল এবং জামায় আটকে আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচিছল। তখন আমি ধৈর্যধারণ করতে পারলাম না। অবশেষে নীচে নেমে এসে তাদের উঠিয়ে নিলাম’।[27]

(খ) রাসূল (ছাঃ)-এর সাথেহাসান (রাঃ)-এর সাদৃশ্য :

রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারার সাথে হাসান (রাঃ)-এর অত্যধিক মিল ছিল। আবু জুহাইফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ أَشْبَهَ النَّاسِ بِهِ الْحَسَنُ بْنُ عَلِىٍّ. ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখেছি। তিনি ছিলেন হাসান বিন আলী (রাঃ)-এর সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ’।[28] আনাস (রাঃ) বলেন, لَمْ يَكُنْ أَحَدٌ أَشْبَهَ بِالنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم مِنَ الْحَسَنِ بْنِ عَلِىٍّ. ‘হাসান ইবনু আলী (রাঃ) অপেক্ষা নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কেউ ছিলেন না’।[29]

(গ) হাসান (রাঃ) আহলে বায়তের অন্তর্গত :

হাসান (রাঃ)-এর বিশেষ মর্যাদার আরেকটি দিক হচ্ছে তিনি আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ছাফিয়া বিনতে শায়বা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আয়েশা (রাঃ) বলেছেন,خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَدَاةً وَعَلَيْهِ مِرْطٌ مُرَحَّلٌ، مِنْ شَعْرٍ أَسْوَدَ، فَجَاءَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ فَأَدْخَلَهُ، ثُمَّ جَاءَ الْحُسَيْنُ فَدَخَلَ مَعَهُ، ثُمَّ جَاءَتْ فَاطِمَةُ فَأَدْخَلَهَا، ثُمَّ جَاءَ عَلِيٌّ فَأَدْخَلَهُ، ثُمَّ قَالَ: {إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا} ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকালে বের হ’লেন। তার পরনে ছিল কালো পশমের নকশীদার চাদর। হাসান ইবনু আলী (রাঃ) আসলেন, তিনি তাকে চাদরের ভেতর প্রবেশ করিয়ে নিলেন। হুসায়ন ইবনু আলী (রাঃ) আসলেন, তিনিও চাদরের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লেন। ফাতেমা (রাঃ) আসলেন, তাকেও ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললেন। তারপর আলী (রাঃ) আসলেন তাকেও ভেতরে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপরে বললেন, হে আহলে বায়ত আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের হ’তে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করে তোমাদের পবিত্র করতে চান’ (আহযাব ৩৩/৩৩)[30]

(ঘ)হাসান ও হুসাইন (রাঃ) দুনিয়ার দু’টি সুগন্ধি ফুল :

পৃথিবীতে সবাই ফুল ভালবাসে। সে ফুলে সুগন্ধি থাকলে তা মানুষের হৃদয় কেড়ে নেয়। রাসূল (ছাঃ) হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-কে সুগন্ধি ফুলের সাথে তুলনা করেছেন। হাদীছে এসেছে, ইবনু আবূ নু‘আয়ম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, كُنْتُ شَاهِدًا لاِبْنِ عُمَرَ وَسَأَلَهُ رَجُلٌ عَنْ دَمِ الْبَعُوضِ. فَقَالَ مِمَّنْ أَنْتَ فَقَالَ مِنْ أَهْلِ الْعِرَاقِ. قَالَ انْظُرُوا إِلَى هَذَا، يَسْأَلُنِى عَنْ دَمِ الْبَعُوضِ وَقَدْ قَتَلُوا ابْنَ النَّبِىِّ صـ وَسَمِعْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ هُمَا رَيْحَانَتَاىَ مِنَ الدُّنْيَا. ‘আমি ইবনু ওমর (রাঃ)-এর কাছে ছিলাম। তখন তাঁর কাছে জনৈক লোক মশার রক্তের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো। তিনি বললেন, তুমি কোন্ দেশের লোক? সে বলল, আমি ইরাকের বাসিন্দা। ইবনু ওমর (রাঃ) বললেন, তোমরা এর দিকে তাকাও, সে আমাকে মশার রক্তের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে, অথচ তারা নবী করীম (ছাঃ)-এর সন্তানকে (নাতিকে) হত্যা করেছে। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ওরা দু’জন (হাসান ও হুসাইন) দুনিয়াতে আমার দু’টি সুগন্ধি ফুল’।[31]

(ঙ) হাসান (রাঃ) দুনিয়াতে সরদার :

হাসান (রাঃ) দুনিয়াতে নেতা হবেন, যে সুসংবাদ রাসূল (ছাঃ) পূর্বেই দিয়েছিলেন। আবূ বকরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাসান ইবনু আলী (রাঃ) সম্পর্কে বললেন,إِنَّ ابْنِي هَذَا سَيِّدٌ، وَإِنِّي أَرْجُو أَنْ يُصْلِحَ اللهُ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ مِنْ أُمَّتِي، ‘আমার এ ছেলে (নাতী) নেতা হবে। আর আমি কামনা করি, আল্লাহ তার মাধ্যমে আমার উম্মাতের দু’টি দলের মধ্যে সমঝোতা করাবেন’।[32] তিনি অন্যত্র বলেন,إِنَّ ابْنِى هَذَا سَيِّدٌ، وَلَعَلَّ اللهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، ‘আমার এ সন্তান (দৌহিত্র) একজন নেতা। সম্ভবত তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদের দু’টি বড় দলের মধ্যে মীমাংসা করাবেন’।[33]

(চ) হাসান ও হুসাইন (রাঃ) জান্নাতী যুবকদের সরদার :

হাসান (রাঃ)-এর মর্যাদার সবচেয়ে বড় দিক হ’ল তিনি জান্নাতী যুবকদের নেতা হবেন। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الحَسَنُ وَالحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الجَنَّةِ، ‘হাসান ও হুসাইন (রাঃ) জান্নাতী যুবকদের সরদার’।[34] অন্যত্র তিনি বলেন,إِنَّ هَذَا مَلَكٌ لَمْ يَنْزِلِ الأَرْضَ قَطُّ قَبْلَ هَذِهِ اللَّيْلَةِ اسْتَأْذَنَ رَبَّهُ أَنْ يُسَلِّمَ عَلَيَّ وَيُبَشِّرَنِي بِأَنَّ فَاطِمَةَ سَيِّدَةُ نِسَاءِ أَهْلِ الجَنَّةِ وَأَنَّ الحَسَنَ وَالحُسَيْنَ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الجَنَّةِ، ‘একজন ফেরেশতা যিনি আজকের এ রাতের আগে কখনও পৃথিবীতে অবতরণ করেননি। তিনি আমাকে সালাম করার জন্য এবং আমার জন্য এ সুখবর বয়ে আনার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুমতি চেয়েছেন যে, ফাতেমাহ জান্নাতের নারীদের নেত্রী এবং হাসান ও হুসাইন জান্নাতের যুবকদের নেতা’।[35]

ছাহাবায়ে কেরামের নিকটে হাসান (রাঃ)-এর সম্মান :

আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) হাসান (রা)-কে সম্মান করতেন। শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন, ভালবাসতেন এবং তাঁর জন্যে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)ও অনুরূপ করতেন। ওয়াকিদী মূসা ইবনু মুহাম্মাদ সূত্রে তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ওমর (রাঃ) যখন সরকারী কোষাগার ও রাজস্ব বিভাগ প্রবর্তন করে ভাতা ব্যবস্থার প্রচলন করেন, তখন তিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের সমহারে হাসান এবং হুসায়ন (রাঃ)-এর প্রত্যেকের জন্যে ৫০০০ দিরহাম করে সরকারী ভাতা নির্ধারণ করেন। তৃতীয় খলীফা ওছমান (রাঃ)ও হাসান ও হুসায়ন (রাঃ)-কে সম্মান করতেন এবং ভালবাসতেন। শেষ জীবনে ওছমান (রাঃ) গৃহবন্দী হ’লে হাসান (রাঃ) অন্যদের সাথে গলায় তরবারি ঝুলিয়ে বিদ্রোহীদের আক্রমণ থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্যে খলীফার দরজায় প্রহরারত ছিলেন। এতে খলীফা ওছমান (রাঃ) শংকিত হ’লেন, না জানি বিদ্রোহীদের আক্রমণে হাসান (রাঃ)-এর কোন ক্ষতি হয়। তাই তিনি কসম করে তাঁকে নিজ গৃহে ফিরে যাবার অনুরোধ করলেন। খলীফা ওছমান (রাঃ) এ অনুরোধ করেছিলেন আলী (রাঃ)-এর মানসিক প্রশান্তির লক্ষ্যে এবং হাসান (রাঃ)-এর জীবনের ঝুঁকির আশংকায়।

চতুর্থ খলীফা আলী (রাঃ) স্বয়ং পুত্র হাসানকে খুবই সম্মান করতেন, মর্যাদা দিতেন। একদিন তিনি হাসান (রাঃ)-কে বললেন, বৎস! তুমি একটু বক্তব্য দাও, আমি তা শুনব। হাসান (রাঃ) বললেন, আববা আপনি সামনে থাকলে আমার বক্তব্য দিতে লজ্জা করে। আলী (রাঃ) আড়ালে গিয়ে বসলেন, যেখান থেকে বক্তব্য শোনা যায়। হাসান (রাঃ) দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করলেন। আড়াল থেকে আলী (রাঃ) তা শুনছিলেন। তিনি একটি সারগর্ভ ও সুন্দর বক্তব্য দিলেন। বক্তব্য শেষ হবার পর খুশি মনে আলী (রাঃ) বললেন, এরা একে অপরের বংশধর, আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বোত্তম। হাসান ও হুসায়ন (রাঃ) যখন কোন বাহনে আরোহণ করতেন তখন ইব‌নু আববাস (রাঃ) ঐ বাহনের রেকাব ধরে থাকতেন। এতে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) বলতেন, হাসান (রাঃ)-এর মত শিশু কোন মহিলা গর্ভে ধারণ করেনি।[36]

হাসান (রাঃ)-এর ইবাদত-বান্দেগী :

হাসান (রাঃ) অত্যন্ত ইবাদত গুযার মানুষ ছিলেন। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,كَانَ الْحَسَنُ إِذَا صَلَّى الْغَدَاةَ فِي مَسْجِدِ رَسُولِ الله يَجْلِسُ فِي مُصَلَّاهُ يَذْكُرُ اللهَ حَتَّى تَرْتَفِعَ الشَّمْسُ، وَيَجْلِسُ إِلَيْهِ مَنْ يَجْلِسُ مِنْ سَادَاتِ النَّاسِ يَتَحَدَّثُونَ عِنْدَهُ، ثُمَّ يَقُومُ فَيَدْخُلُ عَلَى أُمَّهَاتِ الْمُؤْمِنِينَ فَيُسَلِّمُ عَلَيْهِنَّ وَرُبَّمَا أَتْحَفْنَهُ ثُمَّ يَنْصَرِفُ إِلَى مَنْزِلِهِ. ‘হাসান (রাঃ) মসজিদে নববীতে ফজরের ছালাত আদায় করে মুছাল্লায় (ছালাতের স্থানে) বসে থাকতেন এবং সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিকর করতেন। আর নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ তার সাথে বসে আলোচনা করতেন। অতঃপর তিনি উম্মাহাতুল মুমিনীনদের নিকটে গিয়ে তাঁদেরকে সালাম দিতেন। কোন কোন সময় তাঁরা হাসান (রাঃ)-কে উপহার দিতেন। অতঃপর তিনি বাড়ী ফিরে যেতেন’।[37] হাফেয যাহাবী (রহঃ) উল্লেখ করেন, হাসান (রাঃ) পদব্রজে, কখনো নগ্ন পায়ে ২৫ বার মদীনা মুনাওয়ারা থেকে মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্জ পালন করেছেন এবং উটগুলি তাঁর সামনে থাকতো।[38] আববাস ইবনু ফাযল হাসান ইব্‌ন আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর গৃহে পায়ে হেঁটে যাওয়া ব্যতীত আমি মৃত্যুর পর তাঁর সাথে সাক্ষাত করব তাতে আমি লজ্জাবোধ করি। এ সূত্রে ২০ বার তিনি হজ্জ শেষে পায়ে হেঁটে মদীনায় আসেন।[39]

হাসান (রাঃ)-এর দানশীলতা :

হাসান (রাঃ)-এর পুরো জীবন তাকওয়া, ইবাদত-বন্দেগী, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, মানবতার কল্যাণ কামনা, দয়া-অনুগ্রহ, ধৈর্য-সহনশীলতা, মহানুভবতা ও দানশীলতার অনন্য দৃষ্টান্ত ছিল। তিনি কোন সাহায্য প্রার্থীকে কোন অবস্থায় নিজ গৃহ থেকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। ইবনে সা‘দ আলী বিন যায়েদ যাদ‘আন থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম হাসান (রাঃ) তাঁর সমুদয় সম্পদ দু’বার আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছেন, তিনবার তাঁর অর্ধেক সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ছাদাক্বাহ করে দিয়েছেন।[40]

মুহাম্মাদ ইবন সীরীন বলেছেন, কোন কোন সময় হাসান ইবনু আলী (রাঃ) এক ব্যক্তিকে এক লক্ষ দিরহাম দান করতেন। সাঈদ ইবনু আবদুল আযীয বলেছেন, একদিন হাসান (রাঃ) তাঁর পাশে থাকা এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে, সে মহান আল্লাহর কাছে ১০ হাযার দিরহাম প্রার্থনা করছে। এটি শুনে হাসান (রাঃ) নিজ গৃহে গমন করলেন এবং লোকটির জন্যে ১০ হাযার দিরহাম পাঠিয়ে দিলেন।[41]

ঐতিহাসিকগণ বলেছেন যে, একদা হাসান (রা) এক কৃষ্ণকায় ক্রীতদাসকে দেখলেন যে, সে একটি রুটি খাচ্ছে। তার পাশে ছিল একটি কুকুর। যুবকটি নিজে এক লোকমা খাচ্ছেন আর কুকুরকে এক লোকমা খাওয়াচ্ছেন। পালাক্রমে সে রুটি খাচ্ছিল ও কুকুরকে খাওয়াচ্ছিল। হাসান (রাঃ) বললেন, কিসে তুমি এ মহৎ কাজে উৎসাহিত হয়েছ? যুবকটি বলল, আমি খাব আর কুকুরটি উপোস থাকবে এটি আমার নিকট লজ্জাকর মনে হচ্ছে। তাই এমনটি করছি। হাসান (রাঃ) যুবকটিকে বললেন, ‘আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি এখানে থাক। হাসান (রাঃ) ক্রীতদাসটির মালিকের নিকট গেলেন। তার নিকট থেকে ক্রীতদাসটিকে ক্রয় করে নিয়ে তাকে মুক্ত করে দিলেন। যে বাগানে সে ছিল ঐ বাগানটিও ক্রয় করে তাকে দান করে দিলেন। ক্রীতদাসটি বলল, ওহে আমার মালিক! যার সন্তুষ্টির জন্যে আপনি আমাকে এই বাগান দান করেছেন তাঁরই সন্তুষ্টির জন্যে আমি এই বাগান দান করে দিলাম।[42]

আবূ জা‘ফর বাকির বলেছেন, এক লোক হুসায়ন ইবনু আলী (রা)-এর নিকট কোন এক প্রয়োজনে তাঁর সাহায্য নিতে এসেছিল, হুসায়ন (রাঃ) ই‘তিকাফে ছিলেন। ফলে তিনি সাহায্য করতে অপরাগতা প্রকাশ করলেন। লোকটি সাহায্যের জন্যে হাসান (রা)-এর নিকট গেল। সে তাঁর নিকট সাহায্য চাইল। তিনি তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দিলেন এবং বললেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আমার একজন ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে দেয়া আমার নিকট এক মাস ই‘তিকাফ অপেক্ষা অধিক প্রিয়।[43] যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, কোন ভাইয়ের প্রয়োজনে তার সাথে চলা এই মসজিদে (নববীতে) ১ মাস ই‘তিকাফ করা অপেক্ষা আমার কাছে প্রিয়তর’।[44]

[ক্রমশঃ]

[1]. ড. আলী মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী, আমীরুল মুমিনীন আল-হাসান ইবনু আলী ইবনে আবী ত্বালিব (রাঃ) শাখছিয়াতুহু ওয়া আছরুহু, (কায়রো : দারুত তাওযী‘ ওয়ান নাশর আল-ইসলামিয়া, ১ম প্রকাশ, ১৪২৫ হি./২০০৪ খৃ.), পৃ. ১৭।

[2]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৩/২৪৫ পৃ.।

[3]. আমীরুল মুমিনীন আল-হাসান ইবনু আলী (রাঃ), পৃ. ১৭।

[4]. ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তি‘আব ফী মা‘রিফাতিল আছহাব (বৈরূত: দারুল জীল, ১ম প্রকাশ, ১৪১২হি./১৯৯২খৃ.), ১ম খন্ড, পৃ. ৩৮৪।

[5]. আমীরুল মুমিনীন আল-হাসান ইবনু আলী (রাঃ), পৃ. ১৭।

[6]আহমাদ হা/২৬৯১৭, ২৬৯২১, সনদ হাসান।

[7]. আহমাদ হা/৭৬৯; হাকেম হা/৪৭৮৩; ছহীহ ইবনে হিববান হা/৬৯৫৮, সনদ হাসান।

[8]. আবূদাউদ হা/২৮৪১; ইরওয়া হা/১১৬৭,সনদ ছহীহ।

[9]. তিরমিযী হা/১৫১৯, সনদ হাসান; ইরওয়া হা/১১৭৫।

[10]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৩/২৪৬ পৃ.।

[11]. আমীরুল মুমিনীন আল-হাসান ইবনু আলী (রাঃ), পৃ. ৭৬।

[12]. বুখারী হা/১৪৯১; মুসলিম হা/১০৬৯; মিশকাত হা/১৮২২।

[13]. হুসাইন বিন মুহাম্মাদ বিন হাসান আদ-দিয়ার আল-বাকরী (মৃ. ৯৬৬ হি.), তারীখুল খামীস ফী আহওয়ালে আনফুসিন নাফীস (বৈরূত : দারু ছাদির, তাবি.), ১/৪১৯ পৃ.।

[14]. হাফেয ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৪০৭হি./১৯৮৬খৃ.), ৮/৩৮ পৃ.।

[15]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৩৮ পৃ.।

[16]. আমীরুল মুমিনীন আল-হাসান ইবনু আলী (রাঃ), পৃ. ২৭।

[17]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়াহ, ১/৭৫৯ পৃ.।

[18]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৪/৩৪৭ পৃ.।

[19]. ইবনু মাজাহ হা/১৪৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৯৫৪।

[20]. আহমাদ হা/১৬১২৯; নাসাঈ হা/১১৪১, সনদ হাসান।

[21]. ইবনে খুযাইমা ৮৮৭; বায়হাক্বী ৩২৩৭; ছহীহাহ হা/৩১২।

[22]. বুখারী হা/৫৮৮৪; মুসলিম হা/২৪২১; মিশকাত হা/৬১৩৪।

[23]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/৬৯৬১, হাদীছ ছহীহ।

[24]. মুসলিম হা/২৩১৮; তিরমিযী হা/১৯১১।

[25]. আহমাদ হা/১৭১১১; ইবনু মাজাহ হা/৩৬৬৬; মিশকাত ৪৬৯১, ৪৬৯২; ছহীহুল জামে‘ হা/১৯৮৯।

[26]. আহমাদ হা/১৬৮৯৪, সনদ ছহীহ।

[27]. নাসাঈ হা/১৫৮৫, সনদ ছহীহ।

[28]. আহমাদ হা/১৮৭৭০, সনদ ছহীহ।

[29]. বুখারী হা/৩৭৫২; মিশকাত হা/৬১৩৭।

[30]. মুসলিম হা/২৪২৪; মিশকাত হা/৬১২৭।

[31]. বুখারী হা/৩৭৫৩, ৫৯৯৪; তিরমিযী হা/৩৭৭০।

[32]. বুখারী হা/২৭০৪; আবুদাঊদ হা/৪৬৬২; মিশকাত হা/৬১৩৫।

[33]. বুখারী হা/২৭০৪; মিশকাত হা/৬১৩৫।

[34]. তিরমিযী হা/৩৭৬৮; ছহীহাহ হা/৭৯৬; মিশকাত হা/৬১৬৩।

[35]. তিরমিযী হা/৩৭৮১; মিশকাত হা/৬১৭১; ছহীহাহ হা/২৭৮৫।

[36]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৩৮ পৃ.।

[37]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৩৭ পৃ.।

[38]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৩/২৬৭পৃ.; তাক্বীউদ্দীন মাক্বরেযী (মৃ. ৮৪৫ হি.), ইমতাউল আসমা (বৈরূত : ১ম প্রকাশ ১৯৯৯ খ্রি.), ৫/৩৬১ পৃ.।

[39]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৩৮ পৃ.।

[40]. তারীখুল খামীস ফী আহওয়ালে আনফুসিন নাফীস, ১/৪১৯ পৃ.।

[41]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৩৯ পৃ.।

[42]. ঐ.।

[43]. ঐ.।

[44]. ছহীহাহ হা/৯০৬; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭৬।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

5 × 4 =

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য