হাঁড়ির খবর দিতে ও নিতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। যেকোনো পরিচয়ের শুরুর প্রশ্নই থাকে—আপনার বাড়ি কোথায়? অকপটে চেনা-আধা চেনা-অচেনা মানুষকে নিজের নানান বিষয় জানান দিতে আমাদের কার্পণ্য নেই বললেই চলে। তবে জেনে, না জেনে, সচেতন বা অসচেতনভাবে আপনি যা জানান দিচ্ছেন, দিন শেষে তা কারও জন্য হয়ে উঠছে মূল্যবান তথ্য। বিশেষ করে ডিজিটাল জগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মূল্যবান তথ্যই হয়ে উঠছে মহামূল্যবান সম্পদ।
একটা সময় ছিল, যখন সিঁধ কেটে আপনার মূল্যবান সামগ্রী চুরি করত চোর। এখন আর রাতভর পরিশ্রম করে সিঁধ কাটার প্রয়োজন পড়ে না চোরের। আপনার দেওয়া তথ্যই তার জন্য সিঁধ। তথ্যকেই সিঁধ বানিয়ে, আপনাকে না জানিয়ে, আপনার কাছে না এসেই চুরি করে নিয়ে যেতে পারে আপনার মূল্যবান সম্পদ।
চুরি ঠেকাতে বা কেতাবি ভাষায় বললে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল জগতে নানান পদক্ষেপ প্রচলিত আছে। জটিল প্রযুক্তির নিরাপত্তাদেয়াল, পাসওয়ার্ড, পিন, দু–তিন স্তরবিশিষ্ট ভেরিফিকেশন—এমন অসংখ্য নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রয়োগ আছে ডিজিটাল জগতে।
তবে আপনি তথ্য দিয়ে দিলে সব ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থায়ও আপনার সম্পদ সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হবে না। এ যেন ঘরের চাবি পরকে দিয়ে দেওয়া। তালা যতই মজবুত হোক, চোরের কাছে চাবি থাকলে নিরাপত্তা কি নিশ্চিত করা সম্ভব? ফলে বাস্তবতা হচ্ছে, নিজের সচেতনতাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বা সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা-জাল হিসেবে কার্যকর।
কেবল যোগাযোগের প্রয়োজনে একসময় মুঠোফোনের ব্যবহার শুরু হলেও এখন হাতে থাকা ছোট্ট এ যন্ত্র কেবল যোগাযোগের যন্ত্র হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়, নানা রকম প্রয়োজনীয় ফিচারে এর ব্যবহারের বিস্তৃতি যেমন বেড়েছে, তেমনই হয়ে উঠেছে প্রতিদিনের জীবনের অংশ। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং বা এমএফএসের কল্যাণে আপনার মুঠোফোনই আপনার ডিজিটাল ওয়ালেট। প্রযুক্তির কল্যাণে যখন প্রয়োজন, ঠিক তখনই আপনি ডিজিটাল অর্থ ব্যবহার করতে পারছেন। প্রযুক্তিই আপনাকে আপনার টাকা ব্যবহারে আরও বেশি স্বাধীনতা দিচ্ছে। জীবন সহজ করে তুলছে।
আপনি প্রযুক্তির ব্যবহারে জীবন সহজ করছেন, এগিয়ে চলছেন। এ ক্ষেত্রে থেমে নেই অসাধু ব্যক্তিরাও। আপনাকে লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখি বা আপনার না জানার সুযোগ নিয়ে আগে যারা আপনার কাছে গিয়ে প্রতারণা করত, তারাই এখন তাদের কাজটি করতে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করছে। ফলে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে, ওয়ালেট সুরক্ষিত রাখতে, ডিজিটাল জগৎ সুরক্ষিত রাখতে, আপনার সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
আমরা যখন ছোট ছিলাম, স্কুলে যাওয়ার আগে মা-বাবা সাবধান করে দিতেন, ‘অপরিচিত কারও সঙ্গে যেন কথা বলো না, কেউ যদি বলে তোমার আম্মু-আব্বু পাঠিয়েছে, বিশ্বাস করবে না।’ ছোটবেলায় শেখা সেই মৌলিক সতর্কবার্তাই এখনো প্রযোজ্য। মূল বিষয় হলো সন্দেহ করা। ফোনের ওপ্রান্ত বা সামাজিক অ্যাকাউন্টের অপর প্রান্ত থেকে অপরিচিত বা পরিচিত যে যা–ই দাবি করুক, সত্যতা নিশ্চিত না করে বা তার সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কথা চালিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। কারও সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা চালিয়ে গেলে নিজের অজান্তেই আপনি তার হাতে তথ্য-সিঁধ তুলে দিচ্ছেন। তাই শুরুতেই সন্দেহ করুন।
এমনকি ডিজিটাল জগতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা যেকোনো তথ্য বিশ্বাস করার আগে সন্দেহ করুন, যাচাই করুন। তথ্যের উৎস নিশ্চিত করুন। আপনার মতো করে তার পরিচয় নিশ্চিত করুন, তারপর কথা বাড়ান। ধরুন কেউ ফোন দিয়ে দাবি করল তিনি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ফোন দিয়েছেন। এ তথ্য বিশ্বাস না করে আপনি বরং তাদের কল সেন্টারে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন। আপনার পরিচিত কেউ হয়তো টাকা চেয়ে মেসেজ করেছে, টাকা দেওয়ার আগে নিজে ফোন করে কথা বলে নিন। সব ক্ষেত্রেই, সন্দেহ করুন, নিশ্চিত করুন, তারপর এগিয়ে যান।
অন্তর্জালে জড়ানো আমাদের জীবন। এখন একটি শিশু জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ছবি-তথ্য সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার হয়ে যাচ্ছে। তারপর একটু একটু করে নানান রঙে–ঢঙে এই তথ্য শেয়ারের গল্পটা চলতেই থাকে। বাস্তব জগতের পাশাপাশি ডিজিটাল জগতেও একটি মানুষ তৈরি হতে থাকে একটু একটু করেই। এ থেকে শিগগির মুক্তি পাওয়া বা বিরত থাকার খুব উপায় নেই। সামনের দিনে ডিজিটাল জগৎ ক্রমে আরও শক্তিশালী হতে থাকবে। সহজ যোগাযোগে পৃথিবী ছোট হয়েছে; এর সুবিধার খতিয়ানও ছোট নয়। তাই ডিজিটাল যাত্রাকে বর্জন করে নয়, বরং ডিজিটাল জগতে নিজেদের প্রয়োজনেই নিরাপদ থাকার কৌশলগুলো রপ্ত করতে হবে।
হ্যাঁ, আপনাকে বলছি। আপনি একজন ডিজিটাল নাগরিক। মৌলিক জ্ঞান আর সচেতনতাই আপনাকে নিরাপদ রাখতে পারে। নিরাপদ থাকতে, নিরাপদ রাখতে আপনি প্রযুক্তিবোদ্ধা না হলেও চলবে। তবে আমি বুঝতে পারিনি বা আমি খেয়াল করিনি বা আমি সচেতন ছিলাম না—এসব বিষয় থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। আপনার সচেতনতাই আপনাকে ডিজিটাল জগতে সুরক্ষিত রেখে এর সুবিধাগুলো ব্যবহারের পথ আরও প্রশস্ততর করবে।