অডিট রিপোর্ট জালিয়াতির মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে ১২ হাজার ১৮৭ কোম্পানি কর ফাঁকি দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ঋণের জন্য আর্থিক বিবরণী সম্পদ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। আবার কর ফাঁকি দিতে এসব প্রতিষ্ঠান অডিট রিপোর্টে মুনাফা কম দেখায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের নির্দেশে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্সের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ নজরদারির আওতায় আনবে এনবিআর।
এদিকে জালিয়াতি রোধে পেশাদার হিসাববিদদের সংগঠন দ্য ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) ডাটাবেজ ব্যবহারে এনবিআর সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করবে। আগামী ১২ নভেম্বর ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) নামের এই ডাটাবেজের উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ওইদিনই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ওই অনুষ্ঠানে এনবিআরের টাস্কফোর্স অর্থমন্ত্রীকে কোম্পানি করদাতাদের রিটার্ন জমার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে একটি উপস্থাপনা দেবে। যাতে জাল অডিটের মাধ্যমে রিটার্ন দাখিলের এসব তথ্য উল্লেখ থাকবে।
সূত্র জানায়, গত ১৯ আগস্ট জাল অডিট রিপোর্টের মাধ্যমে কর ফাঁকি, সম্পদ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অতিরিক্ত ঋণগ্রহণ ও বিদেশে অর্থ পাচার ঠেকাতে এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। সংস্থাটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) পরিচালক শাব্বির আহমদের নেতৃত্বে সাত সদস্যবিশিষ্ট এ টাস্কফোর্স কার্যপরিধির আওতায় প্রথমে মাঠ পর্যায় থেকে কোম্পানি করদাতাদের তথ্য সংগ্রহ করে। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে টাস্কফোর্স দেখতে পায়, গত বছর ২৮ হাজার ১৮৭টি প্রতিষ্ঠান আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে। এসবের মধ্যে ১৬ হাজার প্রতিষ্ঠান প্রকৃত অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে। বাকি ১২ হাজার ১৮৭ প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট জালিয়াতির মাধ্যমে বানানো। মূলত এসব প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিতেই জাল রিপোর্ট আয়কর অফিসে জমা দিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে আরজেএসসিতে এক লাখ ৭৬ হাজার ৪০০ কোম্পানি নিবন্ধিত রয়েছে। এর মধ্যে ৭৮ হাজার কোম্পানির করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) রয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো জাল টিআইএনের মাধ্যমে আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নিয়েছে।
এ বিষয়ে আইসিএবির সভাপতি মোহাম্মদ ফারুক যুগান্তরকে বলেন, জাল অডিটের দৌরাত্ম্য বন্ধে এনবিআর ও আইসিএবি যৌথভাবে একটি ডাটাবেজ তৈরি করেছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী ১২ নভেম্বর ডাটাবেজের উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, আইসিএবির ডাটাবেজ পুরো আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি কর্পোরেট কর আদায় বাড়বে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) এই ডাটাবেজ ব্যবহার করতে পারবে। তবে এজন্য তাদের এমওইউ করতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাস্কফোর্সের এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, আইসিএবির হিসাববিদরা গত বছর ১৬ হাজার প্রতিষ্ঠানের অডিট করেছে। পক্ষান্তরে গত বছর কর অঞ্চলগুলোতে ২৮ হাজার রিটার্ন জমা পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশির ভাগেই অসম্পূর্ণ ও ভুল তথ্য দেয়া রয়েছে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের ইচ্ছেমতো রিপোর্ট বানানো হয়। স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্টকে হুবহু কপি করে শুধু সংখ্যার পরিবর্তন করে জাল রিপোর্ট বানিয়ে আয়কর অফিসে জমা দিচ্ছে। অসাধু আয়কর পেশাজীবীদের (আইটিপি) সহযোগিতায় এসব রিপোর্ট বানানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। মূলত কর ফাঁকি দিতেই এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে।
টাস্কফোর্সের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, শুধু অডিট রিপোর্টে স্বচ্ছতা আনা গেলে কর্পোরেট কর আদায় এক হাজার কোটি টাকা বাড়ানো সম্ভব। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা আসবে। ভুয়া, বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেয়ার প্রবণতা কমবে। মাঠ পর্যায়ের কর অফিসগুলো প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন নিরীক্ষার সময় যাতে আইসিএবির ডাটাবেজের সঙ্গে অডিট রিপোর্ট ক্রসচেক করে নেয়, সেজন্য অফিস আদেশ জারি করা হবে।
সূত্র জানায়, কোম্পানি শ্রেণির করদাতাদের রিটার্ন দাখিলে শৃঙ্খলা আনতে ডাটাবেজ তৈরি করা হবে। এ ডাটাবেজের জন্য কর অঞ্চলভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আইসিএবির ডাটাবেজের সঙ্গে এনবিআরের ডাটাবেজের তথ্য মিলিয়ে দেখা হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্টের তথ্য আইসিএবির ডাটাবেজে পাওয়া যাবে না সে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে নোটিশ দেয়া হবে। উপযুক্ত উত্তর না পাওয়া গেলে আয়কর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি এনবিআর বিশেষায়িত সফটওয়্যারের মাধ্যমে আরজেএসসিতে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করবে। যেসব প্রতিষ্ঠান আরজেএসসির নিবন্ধন নিয়েছে, কিন্তু রিটার্ন জমা দিচ্ছে না, মাঠ পর্যায়ে জরিপের মাধ্যমে তাদের খুঁজে বের করা হবে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, আইসিএবির সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান ভালো উদ্যোগ। তবে অডিট রিপোর্টগুলো কতটুকু বস্তুনির্ভর সেটাও বিবেচনা করতে হবে। কারণ বাংলাদেশে কোম্পানিগুলো অডিটর রাখেই দুই নম্বরি করার জন্য। সেখানে এই উদ্যোগ খুব বেশি কাজে আসবে না, এনবিআরেরও কিছু করার থাকবে না। এজন্য সবার আগে অডিটর বা অডিট ফার্মের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে শুধু টাকা পেলেই তারা যেন অডিট রিপোর্টে সই না করে দেয়।
তিনি আরও বলেন, সব ক্ষেত্রে একটি অডিট রিপোর্টের প্রচলন করতে পারলে ঋণ জালিয়াতি বন্ধসহ পুরো আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। বর্তমানে কোম্পানিগুলো দুটি রিপোর্ট বানায়। একটি বানায় ব্যাংকের জন্য। যাতে সম্পদ, মুনাফা বেশি দেখানো হয়। এতে বেশি ঋণ পেতে সুবিধা হয়। আরেকটি বানায় ভ্যাট-ট্যাক্সের জন্য। যাতে কম রিটার্ন দেখানো হয়, কম ট্যাক্স দেয়ার জন্য। ব্যাংক যদি ঋণ দেয়ার আগে এনবিআরের কাছে অডিট রিপোর্ট সম্পর্কে জানতে চায় তাহলে জালিয়াতি বন্ধ অনেকাংশেই সম্ভব।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এনবিআর আইসিএবির ডাটাবেজ ব্যবহারে যে চুক্তি করছে, তা ভালো উদ্যোগ। এতে রিপোর্টের পাশাপাশি অডিটরদের স্বচ্ছতার জায়গা তৈরি হবে। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা গেলে রিপোর্টের তথ্যগত পার্থক্য অনেক আসবে।