২ টাকা দামের একটা সার্জিক্যাল মাস্কের দাম ৬৫ টাকা, ১৬ টাকা দামের এক জোড়া জুতার কভারের দাম ধরা হয়েছে ১১০ টাকা। আবার হ্যালেথেন ওষুধের দাম ১ হাজার ৩২৩ টাকা হলেও ঠিকাদার টেন্ডারে দাম ধরেছেন ১৮৯ টাকা। বেশি ব্যবহৃত পণ্য-ওষুধের কয়েকগুণ বেশি দাম আর কম প্রয়োজন হয় এমন ওষুধের অবিশ্বাস্য রকম দাম কমিয়ে চলছে টেন্ডার জালিয়াতি। তিন বছর ধরে এই জালিয়াতি পন্থায় জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে টেন্ডার বাগিয়ে নিচ্ছে মিস রোকেয়া ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করি একটি কোম্পানি বারবার সর্বনিম্ন দরদাতা হচ্ছে। খতিয়ে দেখতে গিয়ে দরদাতার কৌশল বুঝতে পারি। নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতাকে টেন্ডার দেওয়া হয়। এটা বিবেচনা করা হয় লটের মোট দাম হিসেবে। অনেকগুলো আইটেম মিলিয়ে একটি লট হয়। আলাদাভাবে প্রতিটি পণ্যের দাম খেয়াল না করলে দামের হেরফেরের চালাকি বোঝা যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ক্রেতা বেশি ব্যবহৃত পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়েছেন আর কম ব্যবহৃত পণ্যের দাম কমিয়ে দরপত্র জমা দিয়েছেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে আমরা এবার যেসব আইটেমের দাম বাজার দরের চেয়ে অনেক কম সেগুলো বেশি করে কিনেছি এবং যেগুলোর দাম অনেক বেশি ধরেছে সেগুলো বাদ দিয়েছি। এতে সরকারের অনেক অর্থের সাশ্রয় হয়েছে।’ স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে বিশেষায়িত এই হাসপাতাল। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের জরিপে সব বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউটের মধ্যে প্রথম হয়েছে এই হাসপাতাল। জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, এখানে কানের পর্দা লাগানো, নাকের পলিপ ও হাড়ের অপারেশন, সাইনাস ক্যান্সারের আধুনিক এনডোসকপিক অপারেশন, জিহ্বা, শ্বাসনালির ক্যান্সার, থাইরয়েড গ্রেন্ডের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের অপারেশন করা হয়। গলা না কেটে এনডোসকপির মাধ্যমে থাইরয়েড অপারেশন ব্যবস্থা এখানে আছে। যারা জন্ম থেকে বধির (কানে শোনে না) ও কথা বলতে পারে না তাদের বিনামূল্যে কক্লিয়ার সংযোজন করা হয়। রয়েছে উন্নতমানের অডিওলজি বিভাগ। এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে ২০১৮ সালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৪৪ জন, জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ হাজার ৯৮৬ জন। হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৩ হাজার ১৮৬ জন। ২০১৯ সালে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৬০ হাজার ১৭৮ জন, জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ হাজার ৬৭১ জন। হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৩ হাজার ৪৮৭ জন। এ হাসপাতালে দরিদ্র রোগীর জন্য রয়েছে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও অপারেশনের ব্যবস্থা। মাত্র ১০ টাকার টিকিটে রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১২টি অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে এ হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন বহির্বিভাগ, আন্তবিভাগ ও অপারেশনের রোগীদের সব ওষুধ হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পণ্য কেনা হয় দরপত্রের মাধ্যমে। হাসপাতাল বিজ্ঞপ্তি আহ্বান করে নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দিয়ে থাকে। মিস রোকেয়া ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠানটি গত তিন বছর ধরে টানা সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কার্যাদেশ পেয়ে আসছে। তাদের দেওয়া দামের তুলনায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য অনেক বেশি। অনুসন্ধানে জানা যায়, নিলামে দেওয়া ওষুধের দামের হেরফেরে প্রতি বছর ভীষণ চতুরতার সঙ্গে টেন্ডার বাগিয়ে নিচ্ছে মিস রোকেয়া ইন্টারন্যাশনাল। বেশি ব্যবহৃত কম দামি পণ্য এবং ওষুধের দাম ধরা কয়েছে কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু বেশি দামের খুব অল্প ব্যবহৃত হয় এমন ওষুধের দাম অবিশ্বাস্য কম রাখা হয়েছে। মোট যোগফল মিলিয়ে টেন্ডারে অর্থমূল্য কমে আসছে। কিন্তু আলাদাভাবে ওষুধ ও পণ্যের দাম খেয়াল করলেই ধরা পড়ে এ জালিয়াতি। ২ টাকা দামের একটি সার্জিক্যাল মাস্কের দাম ধরা হয়েছে ৬৫ টাকা, ১৬ টাকা দামের এক জোড়া জুতার কভারের দাম ধরা হয়েছে ১১০ টাকা। ৫৯০ টাকা দামের বালিশ ও কভারের দাম ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৫০ টাকা। এসব পণ্য প্রতিদিনই ব্যবহার হয়। তাই প্রয়োজনও হয় অনেক। হাসপাতাল এগুলো বেশি কেনায় ঠিকাদারের লাভ থাকে বেশি। কানের ড্রপ বেটামেথাসন ও নিওমাইসিনের বাজার মূল্য ৩৫ টাকা। অথচ টেন্ডারে দাম ধরা হয়েছে ৬৯ টাকা। একটা ড্রপেই ঠিকাদার লাভ রেখেছে ৩৪ টাকা। যা ওই ড্রপের দামের প্রায় সমান। গ্লাইকোপাইরোলেট ইনজেকশনের বাজার মূল্য ২০ টাকা। টেন্ডারে দাম ধরা হয়েছে ৯০ টাকা। একটা ইজকেশনে ৭০ টাকা দাম বেশি ধরা হয়েছে। ফ্লুক্সাসিলিন ৫০০ এমজি ইনজেকশনের দাম ৪৫ টাকা, টেন্ডারে দাম উল্লেখ করা হয়েছে ৫৩ টাকা। প্রতিটি ইনজেকশনে লাভ রাখা হয়েছে ৮ টাকা। এই ওষুধ এবং ইনজেকশনগুলো নাক, কান, গলার রোগীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। অথচ এগুলোতে বড় অঙ্কের লাভ রেখে জমা দেওয়া হয়েছে টেন্ডার। এদিকে খুব কম ব্যবহার হয় কিন্তু দামি এমন ওষুধের দাম কমানো হয়েছে। ওষুধের গুণগত মান নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। অজ্ঞানের কাজে ব্যবহৃত হ্যালেথেন প্রতি বোতলের পাইকারি দাম ১৩২৩ দশমিক ৬১ টাকা। ঠিকাদার দাম নির্ধারণ করেছেন ১৮৯ টাকা। গুলাটার এলডিহাইট (সাইডেক্স, যন্ত্রপাতির জীবাণুনাশক) প্রতি বোতলের পাইকারি দাম ১ হাজার ১০০ টাকা, ঠিকাদার দাম ধরেছেন ৪৫০ টাকা। কিন্তু এসব ওষুধ খুব অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয় হাসপাতালে। এ বছরও টেন্ডারে এমন চতুরতা করলে বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। অন্য দরদাতাদের সঙ্গে বিশাল পার্থক্য এবং বারবার একই প্রতিষ্ঠান টেন্ডার পাওয়ায় সন্দেহ আরও দানা বাঁধে। নিলামে উল্লেখ করা প্রতিটি পণ্যের দাম মেলাতে গিয়ে ধরা পড়ে এই জালিয়াতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারি হাসপাতালে রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। নিলামে ওষুধ কেনার ব্যাপারে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়। এ বছর নিলামে অন্য দরদাতাদের সঙ্গে মিস রোকেয়া ইন্টারন্যাশনালের দেওয়া দরে বিশাল ব্যবধান আমাদের নজরে আসে। এই প্রতিষ্ঠান গত তিন বছর ধরে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে টেন্ডার পেয়ে আসছে। বিষয়টি খটকা লাগায় প্রতিটি পণ্য এবং ওষুধের দাম মেলাতে গিয়ে উঠে আসে দামের হেরফেরের এই চিত্র। দরদাতার এই চালাকি বুঝতে পেরে বেশি দাম উল্লেখ করা ওষুধ ও পণ্য না কিনে কম দামে পাওয়া ওষুধ বেশি করে কিনেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে সরকারের প্রায় ১১ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে মিস রোকেয়া ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক ফারুক ভুইয়ার দরপত্রে উল্লেখ করা মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। দরপত্রে দেওয়া রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস রেলগেট এলাকার ঠিকানায় গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি।