স্রষ্টার অস্তিত্বের যৌক্তিক প্রমাণঃ
যুক্তি-বুদ্ধির উপর নির্ভর করে আমরা স্রষ্টার অস্তিত্বের সপক্ষে আরো চারটি প্রমাণ নিম্নে আলোচনা করব।
কার্যকারণ সুত্রঃ
স্রষ্টার বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রমাণ আলোচনার সময়, কার্যকারণ সুত্রের কিছুটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, তবে এখান আমরা কার্যকারণ সংক্রান্ত সুত্রকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করব। কার্যকারণ সুত্র হলো দুইটি ঘটনার মধ্যে যোগসুত্র স্থাপন, যেখানে প্রথম ঘটনা হলো কারন আর দ্বিতীয় ঘটনা হলো প্রতিক্রিয়া, যা প্রথম ঘটনার পরিণতি স্বরূপ। যখনই কোনো কাজ হয়, সেই কাজের ফলাফল হিসাবে আর একটি ঘটনা ঘটবে, সেটা পরিণতি। উদাহরণ স্বরূপ কেউ মাঠের মধ্যে খেলার সময় একটি ফুটবল কে জোড়ে লাথি দিলো, যার ফলশ্রুতিতে এই বলটি মাঠের পাশে অবস্থিত একটি বাড়ীর ভেতরে গিয়ে পড়ল। এই যে বলটি বাড়ীর ভেতরে স্থানান্তরিত হলো এটি হলো দ্বিতীয় ঘটনা, যা প্রথম ঘটনার ( বলে লাথি দেয়ার ) পরিণতি। যখন বাড়ীর বাসিন্দা বাড়ির উঠোনে বলটি দেখতে পেলো, তখন সে নিশ্চিত বুঝে যাবে বলটি খেলার সময় কোনো খেলোয়াড়ের লাথির কারণে তার বাড়ির ভেতরে এসেছে।
উপরোক্ত সংজ্ঞা এবং উদাহরণের আলোকে বলা যায়, কোন কার্যকারণ ব্যাতিত কোনো বস্তু তার অস্তিত্বে আসতে পারেনা। এই যে, আপনারা যারা এই লেখাটি পড়ছেন, কেউ যদি আপনাকে বলে এই লেখাটি কেউ লেখেনি, কিন্তু নিজে নিজেই তার অস্তিত্বে এসেছে, আপনি এ কথা শুনে নিশ্চয়ই তাকে পাগল ঠাওরাবেন।
আরো একটি উদাহরণ দেয়া যাক, আপনি কোনো একটি জাহাজের নাবিক, প্রশান্ত মহাসাগরে ঝড়ে বিদ্ধস্ত হয়ে আপনার জাহাজটি ডুবে গেল, আপনি কোনো মতে একটি লাইফ বয় কে আঁকড়ে ধরে ভাসতে থাকলেন আর ভাসতে ভাসতে একটি দ্বীপে নীত হলেন। দ্বীপে আসার পর আপনি বুঝতে পেলেন, এই দ্বীপটি একটি জন-মানব হীন দ্বীপ, সম্ভবতঃ সভ্য সমাজ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, দ্বীপের মাঝখানে একটি ঘন জঙ্গল আছে। আপনি ক্ষুধা- তৃষ্ণায় কাতর হয়ে খাদ্যের সন্ধানে সেই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। অনেক দূর হাঁটার পর জঙ্গলের মাঝে একটি সুন্দর বাড়ী দেখতে পেলেন, যা আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। বাড়ীটি দেখে আপনার বুকে আশার সঞ্চার হলো আপনি বুঝলেন, এখানে কোনো মানবের বসতি রয়েছে। কিন্তু বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে আপনি কোনো প্রানীর চিহ্ন দেখতে পেলেন না, সবকিছুই পরিপাটি করে সাজানো , দেয়ালে একটি সুন্দর তৈলচিত্র ঝুলছে, ডাইনিং টেবিলে খাদ্য পরিবেশন করা আছে, আপনি সেই খাবার খেলেন। ক্ষুধা-তৃষ্ণার অবসান হলে আপনার হুঁশ হলো গৃহস্বামীর খোঁজ করার, কিন্তু আপনি কাউকে খুজে পেলেননা। কয়েকদিন অতিবাহিত হলো, কেউ সেখানে এলোনা, কিন্তু আপনি প্রতিদিন খাওয়ার টেবিলে খাবার সাজানো পেলেন। আপনি কি ধরে নেবেন এই বাড়ীর কোনো মালিক নেই? বা কেউ এই বাড়ী করেনি? কেউ এখানে থাকেনা? কিন্তু আপনার আবার খটকা লাগলো তাহলে প্রতিদিন আপনাকে খাবার সরবরাহ করছে কে? আপনি রহস্যের কুল কিনারা না করতে পেরে কি এই সিদ্ধান্তে উপনিত হবেন, আসলেই এই বাড়ী নিজে নিজেই তৈরী হয়েছে, নিজে নিজেই খাবার আপনার জন্য টেবিলে উপস্থিত হয়ে যাচ্ছে। না কী আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন এর পেছনে কেউ আছে, কিন্তু আপনি রহস্যের কুল-কিনারা করতে পারছেননা। আমি এখানে রহস্যের সমাধান বের করার ভার পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিলাম।
এখানে যে জিনিসটি প্রণিধান যোগ্য, যখনই আমরা কোনো বই পড়ি, তখন তার লেখকের খোঁজ করি, অংকিত চিত্র দেখলে, এই চিত্রের পেছনে চিত্রকরের কথা মনে উদিত হয়, দালান দেখলে এর নির্মাতা এবং স্থপতির কথা স্মরণে আনি। কিন্তু যখনই আমরা সৃষ্টি দেখি তখন কিভাবে স্রষ্টার অস্তিত্বকে প্রত্যাখ্যান করি? সামান্য একটা সীমানা পিলার দেখতে পেলে আমরা মনে করিনা এটি এমনিতেই হয়েছে, কিন্তু এই মহাবিশ্ব এবং এর মধ্যবর্তী সব কিছু যার গঠন লক্ষ কোটি গুন জটিল, এমনি এমনিই অস্তিত্বে এসেছে তা কি করে সম্ভব? নিশ্চই এর জন্য একজন অতি বুদ্ধিমান স্রষ্টা আছে।
মহাকাশ বিজ্ঞান অনুসারে, এই মহাবিশ্বের একটি শুরু আছে, সময়টি ১৪ বিলিয়ন বছর আগে। বিজ্ঞানীরা বৃহৎ বিস্ফোরণ তত্ত্বের আলোকে এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বে আসার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে, যা উপরে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এই বৃহৎ বিস্ফোরণ তত্ত্ব হঠাৎ সম্প্রসারনের কারণ ব্যাখ্যা করেনা। কার্যকারণ সুত্রানুসারে এই বৃহৎ বিস্ফোরনের নিশ্চয়ই কোনো কারন আছে, আর কারণই হলেন স্রষ্টা।
এখন অবিশ্বাসীরা প্রশ্ন করতে পারে, যেহেতু এই মহাবিশ্বের যেহেতু একজন স্রষ্টা আছে, তাহলে স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করলো? এর পরে আবার প্রশ্ন আসে স্রষ্টার সৃষ্টিকর্তার স্রষ্টা কে? আর এভাবে এই প্রশ্নের ধারা চলতেই থাকবে, যতক্ষন আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবো যে, স্রষ্টা কোনো সৃষ্ট সত্ত্বা নন।
আমরা এই বলে অনুসিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, স্রষ্টা যেহেতু এই মহাবিশ্বকে অস্তিত্বে আনয়ন করেছেন, তিনি সর্বাপেক্ষা শক্তিমান হবেন। তিনি সবচেয়ে বুদ্ধিমান হবেন, যেহেতু তিনি সেই বৈজ্ঞানিক সুত্রাবলী প্রণয়ন করেছেন, যা দ্বারা এই মহাবিশ্ব পরিচালিত হয়। তিনি স্থান, কাল ও বস্তুর উর্দ্ধে হবেন। যেহেতু তিনি অসৃষ্ট, তিনি সময়ের স্রষ্টা ও সময়ের উর্দ্ধে নিত্য, তার কোনো শুরু ও শেষ নেই। স্রষ্টার এই সব গুণাবলীর মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণা লাভ করা যায়।
এখানে ৭ম শতাব্দীর একজন আরবের এক ব্যক্তি সম্পর্কিত একটি সত্য ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে, যিনি আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর গোত্র তাকে পাঠিয়েছিলো মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু লাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কিছু ব্যাপারে আলোচনার জন্য। এই ব্যাক্তিটি সালাতের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শহর মদীনাতে উপস্থিত হন। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সালাতে ইমামতি করছিলেন এবং কুরান তিলাওয়াত করছিলেন, সেই ব্যক্তি তা শুনতে পান। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীচের আয়াতটি পড়ছিলেনঃ
أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُونَ
তারা কি আপনা-আপনিই সৃজিত হয়ে গেছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা?
أَمْ خَلَقُوا السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بَل لَّا يُوقِنُونَ
না তারা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করে না।
(সুরা আত-তুর আয়াত নং- ৩৫-৩৬)
যখন সেই ব্যাক্তি আয়াতগুলি শ্রবন করলো, তার ভাষায় তিনি এভাবে তার অনুভুতি বর্ণনা করেছেন, “ আমার হৃদয় কম্পনে স্তব্ধ হওয়ার উপক্রম হলো, আমার হৃদয় উড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।” এই ব্যক্তিটি আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলো।
যদি কেউ স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে, তাহলে যে কোনো তিনটি অসম্ভব প্রস্তাবনার একটিকে গ্রহণ করেতে হবে, উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ সুবহানুতাআ’লা এই তিনটি সম্ভাব্য শর্তের কথা আলোচনা করেছেনঃ
১। মানুষ শুন্য থেকে আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়েছে। এটা কখনোই সম্ভব নয়, সাধারণ বিবেক- বুদ্ধি দ্বারা এই বিশ্বাসের অসারত্ব ধরা পড়ে, উপরে যুক্তির আলোকে আমরা সেটা ব্যাখ্যা করেছি। কার্যকারণ ব্যাতিত কোনো ফলাফল আশা করা যায়না। ( যদিও বা আধুনিক বিবর্তনবাদীরা এই কথাটিই বিশ্বাস করে)
২। মানুষ নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টি করেছে। এটা একটি অবান্তর বাক্য। কোনো বস্তু নিজেকে নিজে সৃষ্টি করতে পারেনা। এটা বিশ্বাস, বিজ্ঞান ও যুক্তির সুস্পষ্ট পরিপন্থি।
৩। মানুষ এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো মানুষ কি এই অসার দাবী নিয়ে এসেছে?
উপরের তিনটি প্রস্তাবনাই অসম্ভব। আর তাই আল্লাহ এই আয়াতে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, নাস্তিকরা সত্যকে বিশ্বাস করেনা।
সুশৃংখল মহাবিশ্ব ও বুদ্ধিমান সত্ত্বার পরিকল্পনাঃ
الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا مَّا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِن تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِن فُطُورٍ
তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টিতে কোন তফাত দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টিফেরাও; কোন ফাটল দেখতে পাও কি?
(সুরা আল-মূলক আয়াত নং- ৩)
গ্রীক দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, যদি কোথাও নকশা দেখা যায়, তাহলে সেই নকশার পিছনে একজন নকশাকারক থাকতে বাধ্য। আমরা যদি এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি প্রক্রিয়া অবলোকন করি, একটি কণার গঠন প্রনালী ও কার্য পদ্ধতি থেকে শুরু করে অতিকায় ছায়াপথ গুলি পর্যন্ত একটি সুশৃংখল নিয়মের অধীন। এই মহাবিশ্বে তারকা, নিহারিকা কিংবা ছায়াপথের সৃষ্টি এবং ধ্বংস সব কিছুই একটি সুস্পষ্ট নিয়মের অধীনে পরিচালিত হয়। আমরা এই নিয়মের নাম দিয়েছি বৈজ্ঞানিক সুত্র। এই বৈজ্ঞানিক সুত্রই প্রমাণ করে যে, এখানে এক বুদ্ধিমান সত্ত্বা সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে এই বিশ্বজগত নিয়ন্ত্রণ করছেন।
যারা নাস্তিকতায় বিশ্বাসী তারা কথায় কথায় বিজ্ঞানকে তাদের অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করে। তাদের উদ্দেশ্যেই আমরা তাপ-গতি বিদ্যাকে সামনে নিয়ে আসতে চাই। তাপগতি বিদ্যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাপ, চাপ এবং এন্ট্রপি ইত্যাদীর বিভিন্ন ভৌত পরিমাপ নিয়ে কথা বলে। আমরা পুর্বে তাপগতি বিদ্যার ২য় সুত্রে দেখেছি, কোনো যন্ত্রকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে হলে বাইরের শক্তির নিয়ন্ত্রণ জরুরী। তাপগতি বিদ্যার সুত্রানুসারে আমরা যখন শক্তির কথা বলব, তখন এন্ট্রোপির কথা আসে। এন্ট্রোপি হলো এক ধরনের বিশৃংখলা, অর্থাৎ আপনি যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তা স্বঠিকভাবে অর্জিত হবে না এবং এর সাথে বিশৃংখলা তৈরী হবে। নিয়ন্ত্রন হীন অবস্থায় এই বিশৃংখলা বাড়তে থাকে। তাপগতি বিদ্যার সুত্রানুসারে কোনো বিস্ফোরনের মাধ্যমে বিশৃংখলা ব্যাতিত গঠন মূলক কিছু আশা করা যায়না।
এখানে আপনার কর্মস্থলের কথা আসতে পারে, আপনি যেখানে কাজ করেন, যদি নিয়মিত জায়গাটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন না করেন, তাহলে এক সময় আপনার কর্মস্থল আবর্জনার স্তুপে পরিণত হবে। অথবা আপনার শিশু সন্তানের ঘরটির দিকে আপনার নিয়মিত নজর দিতে হবে, নতুবা এক সময় আপনি আবিস্কার করবেন ঘরটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে।
এখন যদি আমরা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার দিকে তাকাই, একটি বিস্ফোরনের পর সম্প্রসারনের দ্বারা এই মহাবিশ্ব অস্তিত্ত্বে এসেছে। তাপগতি বিদ্যার ২য় সুত্রানুসারে বিস্ফোরনের দ্বারা গঠনমূলক কিছু অর্জিত হয়না, এই প্রক্রিয়াতে শুধুই এন্ট্রপি অথবা খুব উচ্চমাত্রার বিশৃংখলা থাকার কথা। সময়ের সাথে সাথে তা শীতল হয়ে কর্মক্ষমতা হারাবে। কিন্তু আমরা সেক্ষেত্রে দেখতে পাই সুনিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনা বা ডিজাইন এবং অতি কম মাত্রার বিশৃংখলার উপস্থিতি।
আমরা জানি সৌদি আরবের মরুভুমিতে খনিজ তেল আছে আর আছে বালি। তেল প্লাস্টিক তৈরীর কাঁচামাল, অপরদিকে বালি সিলিকন চিপ তৈরীর কাঁচামাল। এখন যদি সেখানে আমরা আনবিক বোমার বিস্ফোরন ঘটায় এবং আশা করি সেখান থকে স্বয়ঙ্ক্রিয় ভাবে প্লাস্টিক এবং সিলিকন চিপ তৈরী হয়ে, একটি আইফোন বেরিয়ে আসবে। আমার আশার সাথে কতজন সুর মেলাবেন? নিশ্চয়ই আমার সাথে কেউ একমত হবেননা। মূলত এই বৃহৎ বিস্ফোরণ থেকে একটি সুশৃংখল মহাবিশ্ব তৈরী হবে এই কল্পনা করা আর মরুভুমির বুকে আনবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আই ফোন তৈরী করা একই কথা। কিন্তু নাস্তিক বিজ্ঞানীরা নাছোড় বান্দা, তারা প্রবাবিলিটির তত্ত্ব সামনে এনেছেন এবং বলার চেষ্টা করছেন, এই মহা বিশ্ব কোটি কোটি মহা বিশ্বের মধ্যে একটি, যেটি সুশৃংখলতা প্রাপ্ত হয়েছে।
এই মহা বিশ্ব একটি জটিল গাণিতিক সমীকরণের ফল একটি সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার অংশা। এখানে জীবের গঠন প্রণালীও অনেক জটিল। এখানে একটি কোষের গঠনে এত সুশৃংখল নিয়ম বিদ্যমান যে, একটি পূর্ণাং মানব দেহ তৈরী সুপরিকলিত নকশা ব্যাতিত সম্ভব নয়।
আমরা যদি পৃথিবীর গঠনের কথা চিন্তা করি, সেখানে দেখব, এই পৃথিবী যেন আমাদের বসবাসের উপযোগী করেই বানানো হয়েছে। সৌরজগতে সুর্য থেকে নির্দিষ্ট দূরে এর অবস্থান, এর আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, কক্ষপথের সাথে নির্দষ্ট কোণে হেলানো থাকা, পর্যাপ্ত পানি, পর্যাপ্ত অক্সিজেন, সঠিক পরিমাপে মধ্যাকর্ষন শক্তি, যা অন্য কোথাও বিদ্যমান বলে প্রমাণিত হয়নি। এর গঠন প্রণালী দেখলেই বোঝা যায় এটা মানুষের বসবাসের জন্যই বানানো হয়েছে।
আল্লাহ বলেনঃ
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الأَرْضِ جَمِيعاً ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاء فَسَوَّاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
তিনিই সে সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমীনে রয়েছে সে সমস্ত। তারপর তিনি মনোসংযোগ করেছেন আকাশের প্রতি। বস্তুতঃ তিনি তৈরী করেছেন সাত আসমান। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে অবহিত।
(সুরা বাকারা আয়াত নং- ২৯)
রজার পেনরোজ, নোবেল বিজয়ী একজন ব্রিটিশ গাণিতিক পদার্থ বিজ্ঞানী এর মতে প্রবাবিলিটির সুত্রানুযায়ী এই রকম একটি সুশৃংখল মহাবিশ্ব অস্তিত্বে আসতে হলে, (১০১০)১২৩ সংখ্যক মহাবিশ্ব তৈরী হতে হবে।
আমরা যখন এমন একটি সুশৃংখল মহাবিশ্ব দেখি, তখন এটি বিশ্বাস করা কি যৌক্তিক নয় যে, এর একজন বুদ্ধিমান, ত্রুটি বিহীন স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রণকারী রয়েছে। তিনি ব্যাতিত এই মহাবিশ্ব বিশৃংখলায় ভরে যেত। এই স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করা অর্থ, বিজ্ঞান কেই অস্বীকার করা। যদিওবা বিজ্ঞান মনস্ক নাস্তিকরা বিজ্ঞান কে ধর্মের মতই গ্রহণ করেছে
স্রষ্টা কর্তৃক এই সুশৃংখল মহাবিশ্বে সৃষ্টির পক্ষে আল কুরানুল কারীমের কিছু আয়াত নীচে চয়িত হলোঃ
أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا
আমি কি করিনি ভূমিকে বিছানা
وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا
এবং পর্বতমালাকে পেরেক?
وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا
আমি তোমাদেরকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি,
وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا
তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী,
وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا
রাত্রিকে করেছি আবরণ।
وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا
দিনকে করেছি জীবিকা অর্জনের সময়,
وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا
নির্মান করেছি তোমাদের মাথার উপর মজবুত সপ্ত-আকাশ।
وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا
এবং একটি উজ্জ্বল প্রদীপ সৃষ্টি করেছি।
وَأَنزَلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَاء ثَجَّاجًا
আমি জলধর মেঘমালা থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত করি,
لِنُخْرِجَ بِهِ حَبًّا وَنَبَاتًا
যাতে তদ্দ্বারা উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ।
وَجَنَّاتٍ أَلْفَافًا
ও পাতাঘন উদ্যান।
(সুরা আন-নাবা আয়াত নং- ৬-১৬)
নৈতিক মূল্যবোধ এবং মহাপুরুষ গণঃ
يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ
হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব, তুমি মানুষের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে রাজত্ব কর এবং খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না। তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি, এ কারণে যে, তারা হিসাব দিবসকে ভূলে যায়।
(সুরা সোয়াদ আয়াত নং- ২৬)
ন্যায়- অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ ইত্যাদী শব্দগুলো মানবেতিহাসের শুরু থেকেই বিদ্যমান, মানুষ এই ধারনা গুলোর সাথে পরিচিত। সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষ সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস শুরু করে, তার মূল কারণ হলো অপরের অন্যায়/ক্ষতি থেকে নিজেকে রক্ষা করা, যাতে করে সম্মিলীত ভাবে তারা এই অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে পারে। রাস্ট্রগঠনের পেছনেও একই নিয়ামক কাজ করেছে, যাতে করে রাস্ট্র দুর্বলের অধিকারের নিশ্চয়তা দান করে অর্থাৎ সবলের অত্যাচার থেকে মানুষকে রক্ষা করে। অর্থাৎ দুর্বল যদি সবলের অধিকার নষ্ট করে, তাহলে সেটি অন্যায় হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ন্যায় -অন্যায়ের বোধ মানুষের ভেতর জাগ্রত হলো কি করে। বিবর্তনবাদীরা এক কোষী জীব থেকে আজকের এই জটিল প্রানী ও উদ্ভিদের গঠনের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের যদি প্রশ্ন করা হয়, বস্তুবাদী বিজ্ঞান দ্বারা মনের ব্যাখ্যা কিভাবে করবেন। মূল্যবোধের সংজ্ঞা কি? কোন মূল্যবোধ সঠিক? তার উত্তর তারা দিতে পারবেন না।
এখানে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। বিরল ব্যাতিক্রম ব্যাতিত পৃথিবীর সকল সমাজেই আপন ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ। পৃথিবীর সবচেয়ে মন্দ মানুষ টিও হয়ত, এই বিয়েকে অনৈতিক বলবেন। এখন ধরুন কোনো এক নাস্তিক পরিবারে দুই ভাইবোন বড় হয়ে উঠছে, এই ভাইবোন যখন যৌবনে পদার্পন করলো, তখন ভাইটি লক্ষ্য করলো তার বোনটি অনিন্দ্য সুন্দরী, এই সুন্দর বোনকে অন্য কারো ঘরে বউ করে পাঠানোর পরিবর্তে নিজের বধু করে রাখলেই তো হয়, তাই সে তার নাস্তিক পিতা-মাতাকে এই প্রস্তাব দিলো। পিতা-মাতা কিন্তু প্রস্তাব শুনেই রেগে আগুন, তারা বললো এটা অসম্ভব কারন ব্যাপারটি অনৈতিক। ছেলেটি বললো, এই ‘নৈতিকতা’ বইটির লেখক কে? কেনই বা আমরা তাকে মানব? আমরা মুক্ত-চিন্তার অধিকারী, আমাদের মন যা চায় তাই করব। নাস্তিক বাবা-মা বললো এটি অন্যায়। ছেলেটি পালটা প্রশ্ন করলো কোনটি ন্যায় বা অন্যায় এইটি নির্ধারনের এখতিয়ার কার? আমিতো কারো ক্ষতি করছিনা। আসলে নাস্তিক্যবাদে ছেলেটির উত্তর নেই।
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে তাঁর কাছে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, আপনাকে পশুর থেকে আলাদা করে মর্যাদা দান করেছেন, বিবেক দান করেছেন, পথ প্রদর্শক পাঠিয়ে কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায় সেটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন। আর তাইতো আজ পৃথিবীতে নাস্তিকরা নিজেদের মানবতাবাদী দাবী করে। কিন্তু বিবর্তনবাদ অনুযায়ী মানুষ একটি উন্নত পর্যায়ের পশু বই কিছু নয়।
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা একদল মানুষ দেখতে পাই, যারা দাবি করেছেন, স্রষ্টা তাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন, তাদের মাধ্যমে মানবজাতিকে হেদায়েতের পথ নির্দেশিকা প্রেরণ করেছেন। মানুষকে মানুষ হিসাবে জীবন-ধারনের জন্য নিয়ম নীতি মালা শিক্ষা দিয়েছেন। এই সমস্ত মানুষ ছিলেন অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের অধিকারী, পাপাচার বর্জিত, নির্লোভ, নিরহংকারী এবং সাদা-সিধে। পার্থিব কোন কিছুর জন্য লালায়িত ছিলেননা। শুধু মানুষের ইহজাগতিক ও পারলৌকিক কল্যানই তাদের ব্রত। তাঁরা মানুষকে ন্যায়ের পুরস্কার ও অন্যায়ের শাস্তি কি হবে তা জানিয়েছেন। শাসক গণ তাদের নির্দেশিত পন্থা অবলম্বন করে অত্যাচারীকে শাস্তি দিয়েছেন, পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করেছেন। এই লোকগুলোই আবার কখনো কখনো অত্যাচারের শিকার হয়ে ধরা ধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন। যদি স্রষ্টাই না থাকে তাহলে তাদের কে পাঠিয়েছেন? একে অপরের সাথে পারস্পরিক যোগাযোগ না থাকলেও তাঁরা অনেকটা একই রকম শান্তির বাণী ছড়িয়ে গেছেন। সাধারণ ভাবে মানুষ এদের মহাপুরুষ বলে। আসলে এদের অনেকেই ছিলেন স্রষ্টা প্রেরিত বার্তা-বাহক বা নবী -রসুল।
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولٌ فَإِذَا جَاء رَسُولُهُمْ قُضِيَ بَيْنَهُم بِالْقِسْطِ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ
আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একেকজন রসূল রয়েছে। যখন তাদের কাছে তাদের রসূল ন্যায়দন্ডসহ উপস্থিত হল, তখন আর তাদের উপর জুলুম হয় না।
(সুরা ইউনুসঃ আয়াত নং-৪৭)
নবী-রসুলদের সততার ব্যাপারে আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেনঃ
وَإِنَّهُمْ عِندَنَا لَمِنَ الْمُصْطَفَيْنَ الْأَخْيَارِ
আর তারা আমার কাছে মনোনীত ও সৎলোকদের অন্তর্ভুক্ত।
(সুরা সোয়াদ আয়াত নং-৪৭)
ইতিহাসে আইন কানুন মেনে যখন রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালিত হয়েছে, অন্যায়কারী শাস্তি পেয়েছে, তখন একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত শান্তি এসেছে। আবার মানুষ যখন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছে, অন্যায় কারী বিপর্যয় সৃষ্টি করে, পেশী শক্তির মহড়া দেখিয়ে সমাজে প্রতিপত্তি শালী হয়েছে আর দুর্বল নিপীড়িতরা চোখের জল ফেলেছে। বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদেছে।
আজকের সমাজে একজন কট্টর নাস্তিকও ন্যায় বিচারের কথা বলেন। ইতিহাসে অনেক মানুষ অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছেন, আবার অনেকে নানা ফাঁকফোকড় দিয়ে বিচার এড়িয়ে পার পেয়ে গেছেন। আসলে এই পার্থিব জগতে সকল সুষ্ঠু বিচার সম্ভব নয়। এখানে ডাঃ জাকির নায়েকের একটি উক্তি প্রণিধান যোগ্য। তিনি বলেন, হিটলারের বিরূদ্ধে অভিযোগ আছে, সে ষাট লক্ষ ইহুদীকে পুড়িয়ে মেরেছে, আপনারা যদি হিটলারকে ধরতেও পারতেন, তাহলে তাকে একবারের বেশি পোড়াতে পারতেননা। কিন্তু পরকালে আল্লাহ তাকে আরো উনষাট লক্ষ, নিরানব্বই হাজার, নয় শত নিরানব্বই বার পোড়াতে পারবেন।
আর হ্যাঁ পরকাল যদি না থাকে তাহলে পৃথিবীতে যারা অত্যাচার জুলুম করে পার পেয়ে গেছে, তাদের বিজয়ী ঘোষনা করেতে হয়, আর তাহলে আপনি দুর্বলকে কখনো সবলের অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে পারবেন না। আর তাই যুক্তি বলে স্রষ্টা অবশ্যই আছে, যিনি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবেন।
এটা বিশ্বাস করাটাই যৌক্তিক যে, এই জীবন একটি পরীক্ষার স্থান, স্রষ্টা কর্তৃক পরকালে চুড়ান্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে প্রাপ্য পুরস্কার এবং শাস্তি দেবেন। পরিপুর্ণ ন্যায় বিচার এই যে, মানুষের ভালো ও মন্দ কর্মের পুংখানুপুংখ বিবরণ সংরক্ষণ করা হবে, ভুলে যাওয়া বা অজ্ঞাতসারে ঘটে যাওয়া কোনো কিছুই বাদ যাবেনা। শেষ বিচারের দিন তুলা দন্ডে ভালো ও মন্দ কর্মের ওজন করা হবে এবং সেই অনুযায়ী পুরস্কার ও শাস্তি নির্ধারণ করা হবে। মানুষ যখন এই বিশ্বাস লালন করবে, তখন সে নিশ্চিত ভাবেই ভালো কাজ করতে উদবুদ্ধ হবে এবং মন্দ কাজ করতে ভীত হবে। আর এ ভাবেই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
আল্লাহ বলেনঃ
إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لِّمَنْ خَافَ عَذَابَ الآخِرَةِ ذَلِكَ يَوْمٌ مَّجْمُوعٌ لَّهُ النَّاسُ وَذَلِكَ يَوْمٌ مَّشْهُودٌ
নিশ্চয় ইহার মধ্যে নিদর্শন রয়েছে এমন প্রতিটি মানুষের জন্য যে আখেরাতের আযাবকে ভয় করে। উহা এমন একদিন, যে দিন সব মানুষেই সমবেত হবে, সেদিনটি যে হাযিরের দিন।
(সুরা হুদঃ আয়াত নং- ১০৩)
মুজিযা বা অলৌকিক কর্মঃ
উপরে যে নবী-রসুল বা মহাপুরুষের কথা আমরা আলোচনা করেছি, তারা যখন মানুষের সামনে এলেন এবং বললেন, তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রসুল। মানুষ তাদের বিশ্বাস করতে চাইলনা, এবং অধিকাংশই তাদের উপর মিথ্যারোপ করেছিলো। ইতিহাসে দেখা যায় অতি অল্প সংখ্যক মানুষই সরল পথে ছিলো। এই মানুষেরা তাদের কাছে প্রমাণ চাইলো যে, তারা প্রকৃতই আল্লাহর রসুল। আল্লাহ তাদের চিহ্ন বা নিদর্শন দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন, এই চিহ্ন ছিলো অলৌকিক কর্ম সাধন, ইসলামিক পরিভাষায় যাকে বলে মুজিযা। মুজিযা হলো এমন কোনো কাজ যেটা স্বাভাবিক কার্য কারণের পরিপন্থি, যা মানুষের বোধ-বুদ্ধির বাইরে। যেমন আগুনের কাজ ভস্ম করা, আগুন এই কাজে কখনো বাছ-বিচার করেনা, কিন্তু এমন যদি হয়, কাউকে আগুনে ফেলে দিলো এবং সেখানে সে সুন্দর বসে রইল্ এবং আগুন নিভে যাওয়ার পর সেখান থেকে সে অক্ষত বের হয়ে এলো। এটা হলো অলৌকিক কর্ম বা মুজিযা, আর এটা হয় সরাসরি আল্লাহর নির্দেশে।
আল্লাহ বলেনঃ
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ
আমি আমার রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে।
(সুরা হাদিদঃ আয়াত নং- ২৫)
এই মুজিযা ছিলো কাউকে অলৌকিক উপায়ে বিপদ থেকে রক্ষা করা, যেমনঃ নুহ আলাইহিসসালামও তার সঙ্গী-সাথীদের কে নৌকার মাধ্যমে প্লাবন থেকে রক্ষা করা হয়েছিলো। প্রত্নতাত্তিক খননে এই প্লাবনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যেমন গিলগামেশের ট্যাবলেট।
ইবরাহীম আলাইহিসসালাম কে যখন অগ্নি কুন্ডে নিক্ষেপ করা হলো, আগুন তার জন্য শীতল হয়ে গিয়েছিলো।
ইউনুস আলাইহিসসালাম কে অতিকায় তিমি ভক্ষন করার পরেও তার কিছু না হওয়া এবং জীবন্ত অবস্থায় তিমির পেট থেকে বের হওয়া।
মুসা আলাইহিসসালাম জন্য লোহিত সাগরের ভেতর দিয়ে শুস্ক রাস্তা তৈরী হওয়া, মুসা আলাইহিসসালাম ও তার দলবল সাগর পার হলে, ফেরাউনকে সেই সাগরেই নিমজ্জিত করা।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বদরের যুদ্ধে এক মুঠো ধুলো ছুড়ে দিয়ে মুশরিকদের দৃষ্টি শক্তিকে কাবু করেছিলেন।
কখনো কখনো অলৌকিক কর্ম সাধিত হয়েছে মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, যেমনঃ
সালেহ আলাইহিসসালামের সম্প্রদায় দাবি করেছিলো, তিনি যেন পাহাড় থেকে একটি পূর্ণ বয়স্ক উস্ট্রী বের করে নিয়ে আসেন। তিনি আল্লাহর অনুমতিতে তাই করেছিলেন।
ইসা আলাইহিসসালামের সম্প্রদায় আকাশ থেকে আল্লাহর তরফ থেকে পাঠানো খাদ্য খেতে চেয়েছিলো, আল্লাহ ডালি ভর্তি খাদ্য পাঠিয়েছিলেন।
মক্কার মুশরিকরা মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দাবী করেছিলেন , তিনি যেন তাদের চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করে দেখান, তিনি আল্লাহর অনুমতিতে তাই দেখিয়েছিলেন।
কখনো বা নবী-রসুলদের দৈনন্দিন জীবনের কার্য পরিচালনার জন্য আল্লাহর অনুমতিতে অলৌকিক কর্ম সম্পাদিত হয়েছে, যেমনঃ
মুসা আলাইহিসসালামের লাঠি, এই লাঠি দ্বারা আল্লাহর নির্দেশে অনেক অলৌকিক কর্ম সাধন করেছেন যথাঃ পাথর থেকে বারোটি ঝর্না উদ্গিরন করা। উপরোক্ত সাগর দ্বিখন্ডনের কাজটিও এই লাঠি দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছিলো। এই লাঠি মাটিতে ফেললেই বৃহৎ অজগর হয়ে যেত। উনি বগলে হাত ঢুকালে তা শ্বেত শুভ্র আলোকোজ্জল হয়ে বের হতো।
দাউদ আলাইহিসসালাম আল্লাহর অনুমতিতে লোহাকে হাত দিয়ে গলাতে পারতেন, আর এর মাধ্যমে তিনি বর্ম বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
আল্লাহ সুলায়মান আলায়হিসসালাম কে বাতাসের নিয়ন্ত্রণ দান করেছিলেন, তিনি একমাসের পথ একদিনে ভ্রমণ করতেন। জ্বীনদের কে তাঁর অধিনস্ত করে দিয়েছিলেন, তাদের দ্বারা তিনি সাগর থেকে মুক্তো আহরন করতেন, নির্মান কাজ করতেন। তিনি পশু পাখীর ভাষা বুঝতে পারতেন, তাদের সাথে কথা বলতে পারতেন।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অল্প কিছু খাদ্যকে আল্লাহর অনুমতিতে কয়েক শত সাহাবীদের জন্য পেট পুরে খাওয়ার জন্য যথেষ্ট করেছিলেন। পানির স্বল্পতার সময় তার হাত দিয়ে আল্লাহর অনুমতিতে পানি প্রবাহিত করেছিলেন যা উপস্থিত কয়েক শত মানুষের পানীয়, উযু ও প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়।
কখনো প্রতিপক্ষের জন্য শক্ত জবাব হিসাবে নবী-রসুলরা মুজিযা প্রাপ্ত হয়েছেন যেমনঃ
মুসা আলাইহিসসালাম এ সময় মিশরে যাদু বিদ্যায় প্রভুত উন্নতি সাধিত হয়েছিলো, তারা দাবী করতো, যাদুর মাধ্যমে অনেক কিছু সাধন করতো। হাতের লাঠিকে অজগরে পরিণত করে তিনি ফেরাউনের যাদুকরদের পরাজিত করেছিলেন।
ইসা আলাইহিসসালাম শিশু কালে কথা বলে নিজ মায়ের সম্ভ্রম রক্ষা করেছিলেন, তিনি মাটি দিয়ে পাখী বানিয়ে ফুঁ দিলে তা জীবন্ত পাখী হয়ে যেত। তিনি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আল্লাহর অনুমতিতে নিরাময় করতেন। তিনি মৃতকে কবর থেকে আল্লাহর অনুমতিতে জীবিত বের করে আনতে পারতেন।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুজিযা হিসাবে কুরআন দেয়া হয়েছিলো।
উপরোক্ত মুজিযা গুলিই প্রমাণ করে, নবী রসুলেরা যেই অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করেছিলেন, তা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা সম্ভব তার পক্ষে যিনি এই মহাবিশ্বের সকল প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই করেন, তাঁর কাছে কোনো কিছুই কঠিন নয়, তিনি হও বললেই তা হয়ে যায়। তিনিই আমাদের রব, আমাদের স্রষ্টা আল্লাহ।
এখন একজন তথাকথিত নাস্তিক বলতে পারে, নবী-রসুলরা যে উপরে উল্লেখিত অলৌকিক কার্য সম্পাদন করেছে তার প্রমাণ কি? একে বিশ্বাস করার কি কারণ রয়েছে। আসলেই পুর্ববর্তী নবী রসুলরা যে মুজিযা প্রাপ্ত হয়েছিলেন তা তাদের সেই সময়ের মানুষের জন্যই প্রযোজ্য ছিলো। বর্তমান সময়ে তাদের সেই মূজিযা প্রমাণ সম্ভব নয়। তাহলে কি নাস্তিকদের কাছে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য কোনো মুজিযা নেই? অবশ্যই আছে আর তাহলো আল -কুরআন , সেই গ্রন্থ যা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন।
(চলবে)