হিজাব হচ্ছে ব্রডার এস্পেক্টে ইসলাম মানুষকে যে মডেস্টি এবং চারিত্রিক উৎকর্ষতা শিক্ষা দেয় তারই একটা অংশ। হিজাব নিয়ে ভুল ধারনার অভাব নেই, কিছু তো সত্যিকার অর্থেই ভুল ধারণা, আর কিছু হচ্ছে ইসলামকে হেয় করার প্রবণতা। আবার যেসব প্রাক্টিসিং মুসলিম, কিংবা মুসলিমাহ হিজাব পরে তাদেরও অনেক ভুল ধারনা আছে, এই পোস্ট নারীদের হিজাব নিয়ে।
১। ‘হিজাব আরবের সংক্সৃতি, কোর’আনে হিজাব করতে বলা নেই’
এক প্রফেসরকে বলতে দেখেছি, “আরবের মরভূমির বালু থেকে বাঁচতে তারা হিজাব পরতো, এটা ইসলামে নেই”। এই দেশের কেউ কোন বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করলে ধরে নেয় ইসলাম নিয়েও তারা বিশাল পণ্ডিত, যদিও ইসলাম নিয়ে তাদের একাডেমিক পড়াশোনা ‘জিরো’। মরভূমির বালু থেকে বাঁচার জন্য হিজাব পরলে, পুরুষ মহিলার হিজাবের ধরণ একই হতো। যাই হোক, মুসলিম নর-নারীদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক, মানে ফরজ। নারীদের হিজাব বিষয়ে কোর’আনের আয়াত গুলো নিম্নে দেয়া হল।
“হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রী, মেয়ে ও সাধারণ মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন তাদের চাদর (থেকে কিয়দংশ) নিজেদের ওপর টেনে দেয়”। [আল কোর’আন ৩৩:৫৯]
“তুমি মুমিন নারীদেরও বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমুহের হেফাযত করে, তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে না বেড়ায়, তবে তার (শরীরের) যে অংশ (এমনিই) খোলা থাকে (তার কথা আলাদা), তারা যেন তাদের বক্ষদেশ মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে রাখে…[আয়াতের এই অংশে যাদের সামনে হিজাব বাধ্যতামূলক নয় তাদের লিস্ট দেয়া আছে]…এসব মানুষ ছাড়া (যাদের সামনে হিজাবের বাধ্যবাধকতা নেই) তারা যেন অন্য কারো সামনে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, (চলার সময়) যমীনের ওপর তারা যেন এমনভাবে পা না রাখে- যে সৌন্দর্য তারা গোপন করে রেখেছিল তা (পায়ের আওয়াজে) লোকদের কাছে জানাজানি হয়ে যায়”। [আল কোর’আন ২৪:৩১]
“বৃদ্ধা নারী, যাদের এখন আর কারো বিয়ের (বন্ধনে আসার) আশা নেই, তাদের ওপর কোনো দোষ নেই, যদি তারা তাদের (শরীর থেকে অতিরিক্ত) কাপড় খুলে রাখে, (তবে শর্ত হচ্ছে) তারা সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী হবেনা” [আল কোর’আন ২৪:৬০]
আয়াতে বলা হচ্ছে যদি কেউ বৃদ্ধ হয়, মানে সন্তান ধারণের সক্ষমতা শেষ হয়ে যায়, তাদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক নয়। বোঝা যাচ্ছে, যাদের সন্তান ধারণের সক্ষমতা আছে, যারা যুবতী তাদের হিজাব বাধ্যতামূলক।
২। অনেক বোনকেও দেখা যায় কলেজ-ভার্সিটিতে নিয়মিত হিজাব পরে আসে কিন্তু যখন কোন অনুষ্ঠানে যায় তখন হিজাবের আর ধার-ধারেনা।
হিজাব কেন পরবো এই বিষয়টা আগে ঠিক হওয়া দরকার। কেউ যদি এই জন্য হিজাব পরে যে এটা এখন একটা ট্রেন্ড, কিংবা হিজাব পরলে তাকে আরো সুন্দর লাগে, তাহলে হিজাব পরার যে ‘পুরুস্কার’ আল্লাহ তার জন্য রেখেছেন তা সে পাবেনা। হিজাব আল্লাহ’র হুকুম, হিজাব একটি ইবাদাহ, ইবাদাতের শর্ত হচ্ছে শুদ্ধ নিয়াত, কেউ যদি লোক দেখানোর জন্য হিজাব পরে তার জন্য কোন রিওয়ার্ড নেই। যারা আল্লাহ’র হুকুম পালনের জন্য হিজাব পরে তাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের দিন হিজাব মুবাহ হয়ে যায়না। আরেকটা বিষয়, বিশেষ করে মুসলিম বোনদের জন্য, যদি তারা হিজাব করে, তবে এটা তাদেরকে যেকোন অশ্লীল অনুষ্ঠানে যাওয়া থেকে দূরে রাখবে। জন্মদিন, বসন্ত বরণ, কিংবা গায়ে হলুদের মতো যেসব অনুষ্ঠান সেখানে হিজাব পরে একটা মেয়ে ইচ্ছা করেই যাবেনা, কারণ সেখানে অন্যরা যেসব ড্রেস পরে আসে, তার সাথে সত্যিকার অর্থে হিজাব-নিকাব যায়না।
৩। যেসব বোনেরা আউটডোর জব করতে চায়, বিশেষ করে কর্পোরেট অফিস গুলোতে, দেখা যায় অফিসে এসে হিজাব খুলে সারাদিন থাকে, যেন অফিসের কলিগরা মাহরাম!
সারা দিন হিজাব পরে থাকা কষ্টকর কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু ব্যাপারটাকে এভাবে দেখা যায়, আমরাতো দুনিয়ার জন্য শত কষ্ট করি, আখিরাতের জন্যেওতো কিছু কষ্ট করা লাগবে। তবে সত্যিকার অর্থে এই কষ্টটা বেশীরভাগ নারীদের নিজেদের বেছে নেয়া, ইসলামের সাধারণ নির্দেশনা হচ্ছে ‘নারীরা ঘরে অবস্থান করবে’ (দেখুন- আল কোর’আন ৩৩:৩৩), আর তাদের ভরণ পোষণের দায়ভার আল্লাহ তাদের ওপর চাপিয়ে দেননি। তবে কেউ যদি কিছু করতেই চায়, কিংবা করা জরুরী হয়ে পড়ে, বর্তমানে আসলে ঘরে বসেই অনেক কিছু করা যায়, আর আউটডোর জব করতে চাইলে, তাদের উচিত এমন জব চয়েস করা যেখানে হিজাব করা সহজ হয়, আর আমাদের উচিত সর্বাবস্থায় আল্লাহ কাছে দো’আ করা যেন আল্লাহ বিষয়গুলো আমাদের জন্য সহজ করে দেন।
৪। কাজিনদের সামনে হিজাব না করা।
খালাতো ভাই বোন, ফুফাতো ভাই বোন, চাচাতো ভাই বোন, মামাতো ভাই বোন ইত্যাদি একে অপরের মাহরাম না, তাদের সামনে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক [রেফারেন্সের জন্য দেখুন সূরা নুরের ৩১ নাম্বার আয়াত]। এখানে আগে পুরুষদের কথা বলি, অনেকেই খালাতো মামাতো ইত্যাদি বোন থাকলে তাদের সাথে খোশগল্পে মত্ত থাকে, এমনকি একে অন্যকে টাচও করে; এসব সম্পূর্ণ হারাম, খালাতো বোন আপনার আপন বোন না!
বাংলাদেশী সোশাইটিতে (বিশেষ করে গ্রামে) ফ্যামিলিতে কাজিনদের সামনে হিজাব করা আসলেই কষ্টকর। অবস্থা এমন যে অনেক বোন (ইভেন প্রাক্টিসিং) বিষয়টাতে একেবারেই হাল ছেড়ে দেয়। এজন্য আমরা যারা পুরুষ তাদের উচিত আমাদের মা-বোন-স্ত্রীরা যাতে হিজাব মেইনটেন করতে পারে বাসায়, বাড়িতে সেই ব্যবস্থা করা।
৫। নিকাব
এই বিষয়ে তিনটি মত হচ্ছে:
ক) নিকাব পরার দরকার নেই, কেউ নিকাব পরলে আলাদা রিওয়ার্ড পাবেনা।
খ) নিকাব বাধ্যতামূলক না, তবে কেউ পরলে রিওয়ার্ড পাবে, মানে উত্তম।
গ) বর্তমান সময়ে নিকাব বাধ্যতামূলক, নিকাব হিজাবের অংশ, মানে নিকাব ছাড়া নারীদের হিজাব হবেনা।
এখানে একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় আছে, তা হলো যেসব বোন আউটডোর জব করেনা, তাদের জন্য নিকাব পরা অনেক সহজ, কারণ তারা খুব অল্প সময়ের জন্যেই কোন প্রয়োজনে বাইরে যায়, অল্প সময়ে নিকাব পরা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু যাদের সারাক্ষণ বাইরে থাকতে হয়, তাদের জন্য বিষয়টা টাফ। বিশেষ করে যারা কর্পোরেট জব করে, নিকাব আসলে কর্পোরেট অফিস গুলোর পরিবেশের সাথে যায়না, তাই তারা নিকাব করতে চাইলেও তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, অথচ তাদেরই নিকাব পরা বেশী দরকার।
সার্বিকভাবে হিজাবের উদ্দেশ্যের দিকে তাকালে নিকাবের যুক্তিই স্ট্রং, মানে নিকাব ছাড়া হিজাব হয়না। অবশ্যই আল্লাহ আমাদের অন্তরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানেন, যদি কোন সৎ কাজ আমরা আল্লাহ’র হুকুম মানার উদ্দেশ্যে করি, আমাদের উচিত বিষয়টা সিরিয়াসলি দেখা।
৬। “নারীদের হিজাব কত কঠিন, আর পুরুষদের কত সহজ!”
বিষয়টা সত্যি না। যদি শুধু ড্রেসকোড এর দৃষ্টিতে বলা হয় (যা হিজাবের একটি অংশ) তবে নারীদের হিজাব পুরুষদের থেকে বিস্তৃত হবে এটাই স্বাভাবিক, আল্লাহ তাদেরকে এভাবে সৃষ্টি করেছেন, তাদের শরীরিক গঠন পুরুষদের থেকে আলাদা। পুরুষদের টেস্ট অন্যখানে, ‘চক্ষু হিফাজত করা’, ‘লজ্জাস্থান হিফাজত করা’ এই দু’টো বিষয় যে একটা পুরুষের জন্য কিরকম কঠিন তা লিখে বোঝানো যাবেনা। এজন্যেই সম্ভবত আল্লাহ সূরা নূরে প্রথমে পুরুষদের চক্ষু ও লজ্জাস্থান সংরক্ষণের কথা বলেছেন, এরপর নারীদেরকে। এছাড়াও সবকিছুতে নারী পুরুষকে একই পাল্লায় মাপা হচ্ছে ফেমিনিস্ট চিন্তা ভাবনা, নারী পুরুষের টেস্ট আলাদা, যেমন: পুরুষের টেস্ট হচ্ছে তার পরিবারের জন্য হালাল জীবিকার ব্যবস্থা করা, এখানে কোন ছাড় নেই, নারীর জন্য এখানে ছাড় দেয়া হয়েছে। আবার জিহাদ যখন ফরজ হয়, তখন পুরুষদের জন্য কোন ছাড় নেই, নারীর জন্য জিহাদ কখনোই ফরজ নয়।
অন্যদৃষ্টিতে বলা যায়, আমরা যদি ইসলামের টোটাল কনসেপ্ট এর দিকে তাকাই, একটা নারীকে কিন্তু সারাক্ষণ হিজাব-নিকাব পরে থাকতে হচ্ছেনা। ইসলামের সাধারণ নির্দেশনা নারীরা ঘরে থাকবে, আর ঘরে থাকাকালীন মাহরামদের সামনে হিজাব পড়তে হয়না, তারা যে কোন শালীন পোশাক পরতে পারে। যেসব নারীরা আউটডোর জব করতে চায়, তাদেরকে দু’ভাগে ফেলা যায়, এক: যারা ‘নারী ক্ষমতায়নে’ বিশ্বাসী হয়ে আউটডোর জব করতে চায়, এদের ক্ষেত্রে বলতে হয় যদি কেউ নিজের জন্য কোন কিছু কঠিন করে নেয় তাহলে কার কি করার আছে! দুই: যাদের আউটডোর জব করা সত্যিই দরকার, যেমন:
ক) অনেকেই আছে এক মেয়ে, বৃদ্ধ মা-বাবা মেয়ের ওপর নির্ভরশীল;
খ) ভাইরা মা-বাবার তেমন খবর রাখেনা, তাদের ভরণ পোষণ দেয়না;
গ) স্বামী মারা গেছে, নিজেদের পরিবারে খরচ মেটাতে চাকরি ছাড়া উপায় নাই;
ঘ) আবার আরেক গ্রুপ আছে তারা চাকরি করতে চায় এইজন্য যে যদি জীবনের কোন এক পর্যায়ে হাজব্যান্ড এর সাথে বনিবনা না হয়, কিংবা ডিভোর্স হয়ে যায় তাহলে তখনইতো আর ভালো চাকরি পাওয়া যাবেনা।
প্রথম দু’কেসের ক্ষেত্রে বলা যায়, বিয়ের সময় হাজব্যান্ড এর সাথে চুক্তি করে নেয়া যায় যে তার (কনের) মা-বাবাকেও স্বামীকে দেখতে হবে। তৃতীয় কেসের ক্ষেত্রে, তার উচিত নতুন করে আরেকটা বিয়ে করতে চেষ্টা করা। বিধবা নারীকে বিয়ে না করার যে একটা ট্রেন্ড আছে, এই জন্য কিন্তু নারীরাই অনেকাংশে দায়ী। তবে আল্লাহ’র কাছে চাইলে আল্লাহ তার জন্য অবশ্যই কাউকে ব্যবস্থা করে দিবেন, তিনিতো সামি’ঊন আলিম, আরহামুর রাহিমীন। আর চতুর্থ কেসের ক্ষেত্রে বলা যায়, আল্লাহ হাইয়ুল কাইয়ুম, তিনি মারাও যাননা, ভুলেও যাননা। মানুষের জীবনে মানুষের ওপর বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা আসতে পারে, আবার আল্লাহই আমাদের এসব পরীক্ষা সহজ করে দেন, উদ্ধার করেন। আমরা আমাদের ভবিষ্যত এর নিয়ন্ত্রক নই, আল্লাহ’র ওপর যখন আমাদের ভরসা কম থাকে, তখনই এসব প্রশ্ন আসে- হোয়াই মি! আমার কী হবে? ইত্যাদি।
সবশেষে বলতে হয়, হিজাব মেইনটেইন করে যেসব হালাল কাজ করা যায়, তা নিজের বাসায় বসে করুক, আর আউটডোর অফিসে তা অবশ্যই ‘হালাল’। আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা আমরা হারাম বলতে পারিনা। কারো যদি জেনুইন নিড থাকে, আল্লাহ’র দুনিয়ায় হালাল যে কোন কিছুই সে করতে পারে, নারী কিংবা পুরুষ। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের ওপর বোঝা বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।