অনুবাদ : আব্দুল বারী বিন সোলায়মান
[১৪৪১ হিজরী মোতাবেক ২০২০ সাল। পবিত্র হজ্জের আরাফার খুতবা প্রদান করেন সঊদী আরবের উচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য, রাজকীয় পরিষদের সম্মানিত উপদেষ্টা এবং প্রাজ্ঞ ইসলামী অর্থনীতিবিদ ফাযীলাতুশ শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে সুলায়মান আল-মানী (রহি.)। উক্ত খুতবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহীর সম্মানিত মুহাদ্দিছ ও ‘আল-ইতিছাম গবেষণা পর্ষদ’-এর গবেষণা সহকারী শায়খ আব্দুল বারী বিন সোলাইমান। খুতবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো। প্রধান সম্পাদক]
আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার। যিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, মার্জনাকারী, মহাপরাক্রমশালী, শক্তিধর ও মহা প্রতাপশালী। তিনি যাবতীয় নিয়তির নির্ধারক এবং মন্দ থেকে ভালোকে পৃথককারী। যিনি অবারিত কল্যাণ ও নে‘মত দিয়ে বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাদেরকে কখনো কখনো বিপদে-আপদে আপতিত করেন, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে মহা ক্ষমতাধর আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অনেক তাৎপর্য ও সমূহ কল্যাণ। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক এবং যাবতীয় গোপন রহস্য সম্পর্কে অবগত। রাত ও দিনে সঙ্ঘটিত সকল বিষয়ের তিনিই নিয়ন্ত্রক। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (ছা.) তাঁর বান্দা ও নির্বাচিত রাসূল। বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার রাসূল (ছা.)-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন,
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
‘তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল এসেছেন। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ, তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী এবং মুমিনদের প্রতি ¯স্নেহশীল, দয়াময়’ (তাওবা, ১২৮)। তার উপর আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক এবং তার ছাহাবী ও তাদের উত্তম অনুসারীদের উপর, যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করা ও কল্যাণের বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আর তারাই সবচেয়ে পুণ্যবান মানুষ।
অতঃপর হে মুসলিমগণ! আমি আপনাদের আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি। যেই উপদেশ তিনি দিয়েছেন পূর্ববর্তী-পরবর্তী সকলকে। আল্লাহ সুবহানাহু এরশাদ করেন,
وَلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُوا اللَّهَ وَإِنْ تَكْفُرُوا فَإِنَّ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ غَنِيًّا حَمِيدًا
‘তোমাদের পূর্বে যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল, তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর যদি তোমরা অস্বীকার করো, তাহলে জেনে রাখো, আসমানে-যমীনে যা কিছু আছে সবকিছু আল্লাহর। আর আল্লাহ অমুখাপেক্ষী ও প্রশংসিত’ (নিসা, ১৩১)। আল্লাহভীতির মাধ্যমেই সকল কল্যাণ বর্ষিত হয় এবং সকল অকল্যাণ বিপদ-মুছীবত দূরীভূত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا
‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন’ (তালাক, ২)। আল্লাহভীতির অর্থ হলো, সত্যের পথে অগ্রগামী হওয়া এবং মন্দ ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা। আল্লাহভীতির সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহর একত্বের স্বীকৃতি দেওয়া এবং সকল ইবাদত শুধু তার জন্যই সম্পাদন করা। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কারও জন্য ছালাত না পড়া, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট দু‘আ না করা, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করা; না যবেহ করা, না মানত করা, না অন্য কোনো ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
‘হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত করো, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারিতা অর্জন করতে পারবে’ (বাক্বারাহ, ২১)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করো না’ (নিসা, ৩৬)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ فَاعْبُدُوهُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ
‘তিনিই তোমাদের রব। তিনি ছাড়া প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই। তিনি সবকিছুর স্রষ্টা। সুতরাং তোমরা তারই ইবাদত করো। তিনি সকল কিছুর তত্ত্বাবধায়ক’ (আন‘আম, ১০২)। তিনি আরও বলেন,
قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّي أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُونَ – وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ – بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُنْ مِنَ الشَّاكِرِينَ
‘হে নবী! বলুন, ওহে মূর্খের দল! তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা করার আদেশ করছ? অথচ আপনার নিকট ও আপনার পূর্বে যারা এসেছিলেন, তাদের সকলের কাছে অহি করা হয়েছিল এই মর্মে যে, যদি আপনি শিরক করেন, তাহলে আপনার আমল বরবাদ হয়ে যাবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। বরং আপনি আল্লাহরই ইবাদত করুন এবং কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত থাকুন’ (যুমার, ৬৪-৬৬)। আর এটাই হচ্ছে কালেমায়ে তাওহীদ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর প্রকৃত দাবি। সেই সাথে ‘মুহাম্মাদ (ছা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ এই স্বীকৃতি দেওয়াও তাওহীদের দাবি। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
‘মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো ব্যক্তির পিতা নন। বরং তিনি হলেন আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত’ (আহযাব, ৪০)। তাই তার পক্ষ থেকে আসা সকল আদেশ মান্য করতে হবে, তার দেওয়া সকল কথা সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে এবং রাসূল (ছা.) কর্তৃক বর্ণিত পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কোনো পদ্ধতিতে আল্লাহর ইবাদত করা যাবে না।
আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। অতএব তাতে নূন্যতম কোনো কিছু সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন নেই। করলে তা হবে নব উদ্ভাবন ও সুস্পষ্ট বিদ‘আত। সকল মুসলিমের উচিত দ্বীনের মধ্যে এই ধরনের নব উদ্ভাবন ও বিদ‘আতকে ঘৃণা করা। এই পবিত্র স্থানে আরাফার এই দিনে নবী মুহাম্মদ (স.) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পুর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে পসন্দ করলাম’ (মায়েদাহ, ৩)।
নবী (ছা.) স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ক্বায়েম করা; সম্পদের মধ্য থেকে হক্বদারদের অতি অল্প পরিমাণ যাকাত প্রদান করা; রামাযানের ছিয়াম রাখা এবং সামর্থ্য থাকলে আল্লাহর সম্মানিত ঘরে গিয়ে হজ্জ করা’।[1] অনুরূপভাবে তিনি ঈমানের রুকনসমূহ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ঈমান হলো- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করা, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস করা, কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস রাখা, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস রাখা, পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং তাক্বদীরের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস রাখা’।[2]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালা এরশাদ করেন,
كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ – فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ – يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
‘অনুরূপভাবে আমি তোমাদের মাঝে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল প্রেরণ করেছি, যিনি তোমাদের সামনে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবেন, তোমাদের পবিত্র করবেন এবং তোমরা যা জানতে না, তা শিখিয়ে দিবেন। সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখব এবং তোমরা আমার কৃতজ্ঞতা আদায় করো, অকৃতজ্ঞ হয়ো না। হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চিতই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’ (বাক্বারাহ, ১৫১-১৫৩)।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ (ছা.)-কে প্রেরণের মাধ্যমে বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করে তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায়, যিকর এবং তাঁর পক্ষ থেকে আগত বিপদে ধৈর্যধারণ করতে অছিয়ত করেছেন। আর মুত্তাক্বীদের বড় বৈশিষ্ট্য হলো বিপদে ধৈর্যধারণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
‘আর যারা অভাবে, রোগে-শোকে ও বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে, তারাই হলো সত্যবাদী লোক এবং তারাই তাক্বওয়াবান’ (বাক্বারাহ, ১৭৭)।
হে মানবমগুলী! নিশ্চয়ই দুনিয়ার জীবন দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত নয়। আর এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে ধৈর্যের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ – الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ – أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
‘আর অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয় তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সকলেই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাব। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ রয়েছে এবং সে সমস্ত লোকই হেদায়াতপ্রাপ্ত’ (বাক্বারাহ, ১৫৫-১৫৭)। তিনি আরও বলেন,
وَلَنَجْزِيَنَّ الَّذِينَ صَبَرُوا أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘আর যারা ধৈর্যধারণ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে তাদের আমলের চেয়ে অধিক উত্তম প্রতিদান দিব’ (নাহল ৯৬)।
বান্দা কেনই বা ধৈর্যধারণ করবে না? অথচ সে তাক্বদীরের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস করে, সে নিশ্চিত বিশ্বাস করে- যা কিছু ঘটেছে, তা কিছুতেই অঘটিত থাকত না। আর যা ঘটেনি, তা কোনো দিনও ঘটবার ছিল না। দুনিয়ার সকলে একত্রিত হলেও আল্লাহর নির্ধারিত সিদ্ধান্ত থেকে তাকে ফেরাতে পারবে না। আল্লাহ সুবহানাহু এরশাদ করেন,
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا
إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
‘পৃথিবীতে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপদই আসুক না কেন, তা জগৎ সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ’ (হাদীদ, ২২)। আর এসব বিপদ-মুছীবত বান্দাকে আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতরাজি ও অবারিত কল্যাণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহ জাল্লা জালালুহু এরশাদ করেন,
وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ اللَّهَ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
‘যদি তোমরা আল্লাহর নে‘মতগুলোকে গণনা করতে শুরু করো, তাহলে তা গণনা করে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, দয়ালু’ (নাহল, ১৮)। আপনারা কি দেখছেন না, আসমান-যমীনের সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের অনুগত করে দিয়েছেন এবং তাঁর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নে‘মতরাজি দিয়ে ভরপুর করে দিয়েছেন?
এই সকল বিপদ-আপদ বান্দাকে তার রবের ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে সে পাপ-পঙ্কিলতা ছেড়ে আশা ও ক্ষমার প্রত্যাশা নিয়ে রবের দিকে ফিরে আসে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَبَلَوْنَاهُمْ بِالْحَسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
‘আর আমি তাদের পরীক্ষা করেছি ভালো ও মন্দ দিয়ে, যেন তারা ফিরে আসে’ (আ‘রাফ, ১৬৮)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
‘আর আমি তাদের বড় শাস্তি না দিয়ে ছোট ছোট শাস্তি আস্বাদন করাই, যেন তারা ফিরে আসে’ (সাজদাহ, ২১)। তিনি আরও বলেন,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَى أُمَمٍ مِنْ قَبْلِكَ فَأَخَذْنَاهُمْ بِالْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ لَعَلَّهُمْ يَتَضَرَّعُونَ
‘আপনার পূর্ববর্তী জাতিসমূহের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি। অতঃপর আমি তাদেরকে অভাব-অনটন ও দুঃখ-দুর্দশা দিয়ে পাকড়াও করেছিলাম, যেন তারা অনুনয়-বিনয় করে’ (আন‘আম, ৪২)। আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
‘হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার তিনি অভাবমুক্ত প্রশংসিত’ (ফাত্বির, ৩৫)।
এ সকল বিপদ-মুছীবত মানুষকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তাদেরকে জান্নাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করে। যেখানে কোনো প্রকার দুঃখ-দুর্দশা ও চিন্তা-দুশ্চিন্তা নেই। আল্লাহ রব্বুল আলামীন এরশাদ করেন,
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘কেউ জানে না, তার কৃতকর্মের ফলস্বরূপ তার জন্য কী কী নয়নাভিরাম প্রতিফল রাখা হয়েছে’ (সাজদাহ, ১৭)। তিনি আরও বলেন,
وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنْفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ وَأَنْتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
‘আর সেখানে রয়েছে যা মনে চায়, যা দেখে চক্ষু শীতল হয়। সেখানে তোমরা চিরস্থায়ী থাকবে’ (যুখরুফ, ৭১)।
এসব বিপদ-আপদের মাধ্যমে বান্দাদের পরীক্ষা করা যায়। বান্দাদের মধ্যে ধৈর্যশীল ও সুফল পাওয়ার যোগ্য বান্দাদের আলাদা করা যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ
‘আমি তোমাদের পরীক্ষা করব ভালো ও মন্দের ফিতনা দিয়ে। আর তোমাদেরকে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে’ (আম্বিয়া, ৩৫)।
বিপদ-আপদ যতই কঠিন হোক না কেন আল্লাহ রব্বুল আলামীন তা চিরস্থায়ী করেন না। আল্লাহর রহমত অধিকতর প্রশস্ত এবং বিপদ থেকে মুক্তি লাভের উপায় তার থেকে মুক্তি নিকটবর্তী। আর আল্লাহ তা‘আলা কষ্ট লাঘবের অঙ্গীকার করেছেন। আল্লাহ জাল্লা জালালুহু এরশাদ করেন,
فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا – إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا
‘নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। অতঃপর কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’ (ইনশিরাহ, ৫-৬)। আল্লাহ জাল্লা জালালুহু বলেন,
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا سَيَجْعَلُ اللَّهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُسْرًا
‘আল্লাহ কারও উপর তার সাধ্যের অতীত কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। অচিরেই আল্লাহ কষ্টের পরে সুখ দেবেন’ (তালাক, ৭)। তিনি আরও বলেন,
يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তিনি তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না’ (বাক্বারাহ, ১৮৫)।
আর এ সকল বিপদ-আপদ আল্লাহর দিকে ফিরে আসার মাধ্যমে তার আনুগত্যের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত করে। কখনো বা বিপদ আসার পূর্বেই তা প্রতিহত করার মাধ্যমে, কখনো বা আপতিত হওয়ার পরে প্রতিকারের উপায়-উপকরণ গ্রহণের মাধ্যমে। শাশ্বত ইসলামী জীবন বিধানে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। বিপদ-আপদ এবং আর্থিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় করণীয় সম্পর্কে ইলাহী দিক-নির্দেশনা এসেছে। যার মাধ্যমে সৃষ্টিজগতে সুখময় জীবন লাভ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ইসলামী শরী‘আহ উপার্জন, উৎপাদন ও কর্মে আত্মনিয়োগ এবং ব্যবসার প্রতি উৎসাহিত করেছে। ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসাকে মৌলিকভাবে হালাল ও জায়েয সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু সূদ ও প্রতারণাকে নিষিদ্ধ ও হারাম আখ্যা দিয়েছে। ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে। পারস্পারিক অঙ্গীকার ও শর্ত পালনের আদেশ করেছে। তেমনিভাবে ব্যবসায়িক লেনদেন ও পারস্পরিক সহযোগিতার বিধিমালা নির্ধারণ করেছে। পারস্পারিক ঋণ পরিশোধ ও অধিকার আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। অপচয় করার ব্যাপারে সতর্ক করেছে। আর অসহায় গরীব-মিসকীনদেরকে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে এবং দান-ছাদাক্বার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিশেষ করে বিপদ-আপদ ও সংকটময় মুহূর্তে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করো’ (মায়েদাহ, ১)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا
‘আর যারা ব্যয় করার সময় অপচয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না। বরং উভয়ে মাঝে সমন্বয় করে চলে’ (ফুরক্বান, ৬৭)। আল্লাহ জাল্লা জালালুহু এরশাদ করেন, وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ, ২৭৫)। তিনি আরও এরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। এটা কেবল তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমেই বৈধ হতে পারে’ (নিসা, ২৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَشْهِدُوا إِذَا تَبَايَعْتُمْ ‘ক্রয়-বিক্রয়ের সময় তোমরা সাক্ষী রাখো’ (বাক্বারাহ, ২৮২)। তিনি আরও বলেছেন,
وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ
‘ওযন ও মাপ পরিপূর্ণ করো’ (আন‘আম, ১৫২)। জান্নাত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘জান্নাত তৈরি করা হয়েছে মুত্তাক্বীদের জন্য। যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় দান করে’ (আলে ইমরান, ১৩৩)।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক সমস্যাবলি থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য ইসলামী শরী‘আহ গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করেছে। পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, সন্তানের লালন-পালন, সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং পারস্পরিক সহানুভূতি ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একে-অন্যের প্রতি অধিকার প্রদান করেছে, সাধারণ মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। পুরুষের অধিকার, নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, বড়দের অধিকার, ছোটদের অধিকার, সুস্থ ও প্রতিবন্ধীদের অধিকার, এমনকি অপরের মনস্তাত্ত্বিক অধিকারের ব্যাপারেও ইসলামী শরী‘আহ গুরুত্বারোপ করেছে। বিপদে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো, পারস্পরিক সদাচরণ, সৌহার্দ-সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার নির্দেশ প্রদান করেছে। অনুরূপভাবে উত্তম চরিত্র, সুন্দর কথা, পরস্পরের মাঝে সহযোগিতা ও সহানুভূতির মনোভাব ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا – وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
‘তোমার রব আদেশ করেছেন তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কোনো একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের প্রতি ‘উফ’ (বিরক্তি প্রকাশক শব্দ) শব্দটিও করো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না; তাদের সাথে উত্তম কথা বল। তাদের প্রতি নমনীয়তার পক্ষপুট অবনত করে দাও এবং বলো, হে আল্লাহ! আমার পিতা-মাতার প্রতি দয়া করো, যেমন তারা শৈশবে আমার প্রতি দয়া করেছিল’ (ইসরা, ২৩-২৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
‘আমারা বান্দাদের বলে দিন! তারা যেন উত্তম কথা বলে’ (ইসরা, ৫৩)। তিনি আরও বলেন,
وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
‘আর তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সদাচরণ করো। যদি তাদেরকে অপসন্দ হয়, তাহলে হতে পারে, তোমরা যেটাকে অপসন্দ করছ আল্লাহ তার মধ্যে বড় কল্যাণ নিহিত রেখেছেন’ (নিসা, ১৯)। তিনি আরও এরশাদ করেন,
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ
يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনদের দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অপসন্দনীয় কাজ ও অবাধ্যতা থেকে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে উপদেশ গ্রহণ করো’ (নাহল ৯০)। আল্লাহ জাল্লা জালালুহু এরশাদ করেন,
وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا
‘আত্মীয়-স্বজনকে তার হক্ব প্রদান করো এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। আর কিছুতেই অপব্যয় করো না’ (ইসরা, ২৬)। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (ছা.) বলছিলেন, ‘সদাচারণ করো তোমার মায়ের সাথে, তোমার বাবার সাথে, বোনের সাথে, ভাইয়ের সাথে, অতঃপর যারা যত নিকটের তাদের সাথে’ (আবুদাঊদ, হা/৫১৪০; নাসাঈ, হা/২৫৩২)।
রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার ব্যাপারে ইসলামী শরী‘আহ এমন ব্যবস্থাপনা রেখেছে, যার দ্বারা রাষ্ট্র ও নাগরিকের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। ইসলামী শরী‘আহ মানুষের অধিকার এবং সম্পদ ও প্রাণের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দিয়েছে। আর অপরের প্রতি সীমালঙ্ঘন করা ও কষ্ট দেওয়াকে নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করেছে। এমনিভাবে পারস্পারিক সংঘাতে ইন্ধন যোগানো এবং সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া, যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা থেকে নিষেধ করেছে। ফিতনা সৃষ্টির যাবতীয় কারণ থেকে বিরত থাকতে, শত্রুকে প্ররোচনা দেওয়া বা শত্রুর প্ররোচনায় পতিত হওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং ন্যায়সংগত কাজে দায়িত্বশীলদের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছে। সর্বোপরি সামাজিক ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় এবং অনিষ্ট ও অকল্যাণ দূরীভূত করার নির্দেশ দিয়েছে এবং পারস্পারিক সমঝোতার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ জাল্লা জালালুহু বলেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ‘তোমরা সকলেই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ় হস্তে ধারণ করো এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান, ১০৩)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ
‘যারা ঈমান এনেছে এবং নিজের ঈমানকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সুপথপ্রাপ্ত’ (আন‘আম, ৮২)। আল্লাহ জাল্লা জালালুহু এরশাদ করেন,
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا – يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার-ফায়ছালা করো তখন ন্যায়ভিত্তিক বিচার করো। আল্লাহ তোমাদেরকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো আল্লাহর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা দায়িত্বশীল তাদের। যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হও তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক থেকে সবচেয়ে উত্তম’ (নিসা, ৫৮-৫৯)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ
إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
‘মানুষকে তাদের প্রাপ্য অধিকার কম দিয়ে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে না এবং যমীনে স্থিতিশীলতা আসার পর ফাসাদ সৃষ্টি করবে না। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বিশ্বাসী হয়ে থাকো’ (আ‘রাফ, ৮৫)। তিনি আরও বলেন,
وَلَا تَقْعُدُوا بِكُلِّ صِرَاطٍ تُوعِدُونَ وَتَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِهِ وَتَبْغُونَهَا عِوَجًا
‘জীবনের পদে পদে এমন দুরাচারী হয়ে যেয়ো না যে, ঈমানদারদের ভয়-ভীতি দেখাবে, তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দিবে এবং সোজা পথকে বক্র করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকবে’ (আ‘রাফ, ৮৬)। রব্বুল আলামীন এরশাদ করেন,
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا
‘যদি মুমিনদের দুই দল ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের মাঝে মীমাংসা করে দাও’ (হুজুরাত, ৯)। রব্বুল আলামীন আরও এরশাদ করেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
‘মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমরা তোমাদের ভাইদের মাঝে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও’ (হুজুরাত, ১০)। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (ছা.) বলেন, ‘জেনে রাখো! তোমাদের রক্ত ও সম্পদ তোমাদের কাছে সম্মানিত, যেমন আজকের এই দিন, এই মাস এবং এই শহর সম্মানিত। আমার মৃত্যুর পরে তোমরা একে অপরকে হত্যা করে কুফরীতে ফিরে যেয়ো না’।[3] অতঃপর তিনি তাদেরকে ইমামের আদেশ শোনা ও মেনে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর বললেন, হে মানবমগুলী! নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক হক্বদারকে তার হক্ব প্রদান করেছেন। অতঃপর বললেন,
اعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَصَلُّوا خَمْسَكُمْ وَصُومُوا شَهْرَكُمْ وَأَدُّوا زَكَاةَ أَمْوَالِكُمْ وَأَطِيعُوا ذَا
أَمْرِكُمْ تَدْخُلُوا جَنَّةَ رَبِّكُمْ
‘তোমরা তোমাদের রব আল্লাহকে ভয় করো, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করো, রামাযানের ছিয়াম রাখো, দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করো, তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে’।[4]
চিকিৎসা সংক্রান্ত দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী শরী‘আহ স্বাস্থ্য ও শারীরিক সুরক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি নির্দেশ প্রদান এবং স্বচ্ছ নির্মল পরিবেশ রক্ষণে নির্দেশ প্রদান। ইসলাম পবিত্র খাদ্যসমূহ বৈধ করেছে এবং ক্ষতিকর ও অনিষ্ট খাদ্য হারাম করেছে। মহামারি ও অন্যান্য রোগ-ব্যাধি থেকে সমাজকে সুরক্ষিত রাখতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। জাল্লা জালালুহু এরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوا
‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা ছালাতের জন্য দাঁড়াবে তখন স্বীয় মুখমগুল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত করো। মাথা মাসাহ করো এবং পদযুগল গিরাসহ ধৌত করো। আর যদি তোমরা অপবিত্র থাকো তাহলে পবিত্রতা অর্জন করো’ (মায়েদাহ, ৬)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, ‘তোমার পোশাক-পরিচ্ছদকে পরিষ্কার করো’ (মুদ্দাছছির, ৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِين ‘আর যখন আমি অসুস্থ হই, তখন তিনিই আমাকে সুস্থতা দান করেন’ (শু‘আরা, ৮০)। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন,
وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ
‘আর তিনি তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করেছেন এবং নোংরা বস্তুসমূহ করেছেন হারাম’ (আ‘রাফ, ১৫৭)। রাসূলে আকরাম (ছা.) বলেছেন, আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো। কারণ এমন কোনো ব্যাধি নেই যার প্রতিষেধক নেই’।[5] রাসূল (ছা.) বলেন, ‘কুষ্ঠ রোগী থেকে পলায়ন করো, যেভাবে সিংহ থেকে পলায়ন করো’।[6] তিনি আরও এরশাদ করেন, ‘অসুস্থকে সুস্থের পাশে নিয়ে আসা যাবে না’।[7] ‘যখন তোমরা কোনো এলাকায় প্লেগের বিস্তারের সংবাদ শুনবে তখন সে এলাকায় প্রবেশ করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান করছ সেখানেই যদি তার বিস্তার ঘটে, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না’।[8]
মহামারি ও দ্রুত বিস্তারকারী ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা সংবলিত হাদীছসমূহের আলোকে রাজকীয় সঊদী গভর্নমেন্ট এ বছর দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অংশগ্রহণে সীমিত সংখ্যক হাজী নিয়ে হজ্জ সম্পাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যাতে স্বাস্থ্যবিধির পূর্ণ অনুসরণ ও প্রয়োজনীয় সুরক্ষা উপকরণ গ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে হজ্জের যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করা যায় এবং এর মাধ্যমে জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধান করা ও মহামরি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়। সর্বোপরি ইসলামী শরী‘আহর অন্যতম উদ্দেশ্য ‘জীবন রক্ষা’ যেন নিশ্চিত করা যায়। জনগণের সুরক্ষা ও এই মহামারির বিস্তার রোধ এবং পবিত্র দুই শহর মক্কা-মদীনাকে সুরক্ষিত রাখার নিমিত্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত এই প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। হারামাইন শরীফাইনের খিদমত ও তার সুরক্ষায় অবদান রাখার জন্য আল্লাহ তা‘আলা খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আযীয ও যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য কর্ণধার ব্যক্তিবর্গকে উত্তম বিনিময় দান করুন। হে আল্লাহ! তাদের নেক কাজের ছওয়ার বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিন এবং অনিষ্টকারীদের অনিষ্ট থেকে তাদের রক্ষা করুন।
মুমিন ব্যক্তি যেমন তাদের জন্য দু‘আ করবে, তার পাশাপাশি নিজের জন্য, পরিবার-পরিজন, দেশবাসী ও সমগ্র মুসলিমের জন্য দু‘আ করবে। যে ব্যক্তি অপর ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দু‘আ করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য একজন ফেরেশতা নিয়োগ করেন, যে তার সাথে আমীন আমীন বলতে থাকে এবং বলে, তোমার জন্য অনুরূপ নির্ধারিত হোক’।[9] বিশেষ করে এই পবিত্র স্থানে পবিত্র আরাফার দিনটি দু‘আ কবুলের অন্যতম সময়। রাসূল (ছা.) বলেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যেই দিনে আল্লাহ এত বেশি মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন, আরাফার দিনের চেয়ে। আল্লাহ নিকটবর্তী হয়ে তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করতে থাকেন…’। [10]
আর এ কারণেই এ দিনে হাজী ছাহেবদের জন্য ছিয়াম না রাখাই উত্তম। যেন তারা বেশি বেশি দু‘আ করার সুযোগ লাভ করে। যেমনটি রাসূলে আকরাম (ছা.) করেছেন। রাসূল (ছা.) আরাফাতের ময়দানের খুতবা প্রদান করলেন এবং বেলাল (রা.)-কে আযানের নির্দেশ দিলেন। আযান দেওয়া হলে ইক্বামত দিতে বললেন। তারপর দুই রাক‘আত যোহরের ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর পুনরায় ইক্বামত দিয়ে দুই রাক‘আত আছরের ছালাত পড়লেন ‘জমা ও ক্বছর’ করে। এর মাধ্যমে নিজেকে দু‘আ, যিকির ও ইস্তিগফারের জন্য প্রস্তুত করে নিলেন। সূর্য ঢলে যাওয়া পর্যন্ত রাসূল (ছা.) দু‘আ, ইস্তিগফার ও আল্লাহর ইবাদতে মশগূল থাকেন। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করেন যিকির-আযকারের মধ্যে মশগূল থাকেন। যখন সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবে গেল তখন মুযদালিফার উদ্দেশ্যে গমন করলেন। সেখানে মাগরিবের ছালাত তিন রাক‘আত ও এশার ছালাত দুই রাক‘আত ‘জমা ও ক্বছর’ করে আদায় করলেন। মুযদালিফার মাঠে রাত্রি যাপন করলেন। অতঃপর ফজর পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। ফজর যখন স্পষ্ট হলো তিনি মিনা অভিমুখে রওনা হলেন। অতঃপর বড় জামরার কাছে এসে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর কুরবানী করলেন এবং মাথা মুণ্ডন করলেন। এরপর কা‘বাতে গিয়ে ত্বাওয়াফে ইফাযা করলেন। অতঃপর তাশরীকের দিনগুলোতে মিনায় অবস্থানের মধ্য দিয়ে তিন দিন সেখানে যিকির-আযকার ও জামরায় পাথর নিক্ষেপের কাজ সম্পাদন করলেন। যখন হজ্জের সকল কার্যক্রম পূর্ণ হলো এবং ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা করলেন তখন তিনি কা‘বাতে গিয়ে ত্বাওয়াফে বিদা‘ করলেন।
হে মুসলিমগণ! নিশ্চয় কল্যাণ ও নে‘মত প্রাপ্তি ও শাস্তি হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য সর্বোত্তম সম্বল হলো আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে দু‘আ করা। তিনি বলেছেন,
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ
‘যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে জানতে চাই, তখন তাদের বলে দিন, আমি তাদের নিকটেই আছি। আমি আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দিই, যখন সে আমাকে আহ্বান করে’ (বাক্বারাহ, ১৮৬)। তিনি আরও বলেন,
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ
‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে প্রার্থনা করো, তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবেন’ (গাফির, ৬০)।
অতএব, হে মুসলিমগণ! আপনারা বিনয় ও একনিষ্ঠতা এবং বিশ্বাস ও কবুল হওয়া আশা নিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন। নিজের এবং অন্যের দু‘আয় আমীন আমীন বলুন। হে আল্লাহ! এই মহামারি দূর করে দিন! যারা অসুস্থ তাদের সুস্থতা দান করুন! যারা অসুস্থদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবদান রাখেছে তাদের সক্ষমতা দান করুন এবং তাদের সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ ও টীকা উদ্ভাবনের তাওফীক্ব দান করুন! হে আল্লাহ! আপনার নে‘মত দিয়ে আমাদের সকলকে পরিপূর্ণ করে দিন! আপনার অনুগ্রহে আমাদেরকে ধন্য করুন! হে আল্লাহ! তাদের ও আমাদের সকলের অন্তরে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে দিন! হে আল্লাহ! আমাদের পরস্পরকে আল্লাহভীতি ও সৎকাজের সহযোগী বানিয়ে দিন এবং পাপাচার ও সীমালঙ্ঘনের কাজে নয়। হে আল্লাহ! আপনি অনুগ্রহ ও করুণা দিয়ে আমাদেরকে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা দান করুন।
হে আল্লাহ! আপনি খাদেমুল হারামাইন শারীফাইনের উপর সুস্থতা ও নিরাপত্তা বর্ষন করো, আপনার ক্ষমতা দ্বারা তাকে শক্তিশালী করুন, হারামাইন শারীফাইন ও তার দর্শনার্থীদের খেদমত করার যে মহান দায়িত্ব আপনি তাকে অর্পন করে করেছেন তা বাস্তবায়ন করার তাওফীক্ব দান করুন। আর এটাকে তার জন্য আপনার নিকট নূরের মিম্বারে গচ্ছিত নেকী হিসাবে জমা রাখুন এবং তার বান্দা যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমানকে সঠিক পথে পরিচালিত করো।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনদের দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অপসন্দনীয় কাজ ও অবাধ্যতা থেকে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে উপদেশ গ্রহণ করো’ (নাহল ৯০)। সুতরাং মহান আল্লাহকে স্মরণ রাখুন। আল্লাহও আপনাদের স্মরণে রাখবেন। তার দেওয়া নে’মতের কৃতজ্ঞতা আদায় করুন, তাহলে তিনি তার নে’মত বৃদ্ধি করে দিবেন। আপনাদের রাসূল ও নবী মুহাম্মাদ (ছা.)এর, তার পরিবারবর্গ ও সকল ছাহাবীদের প্রতি উপর দুরূদ পাঠ করুন। সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।
وَصَلَّى اللَّهُ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ أَجْمَعِيْنَ
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/৮।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/১৭৩৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৭৯।
[4]. তিরমিযী, হা/৬১৬; মিশকাত, হা/৫৭১।
[5]. মিরকাতুল মাফাতীহ, ৭/২৮৬১, সমর্থক হাদীছ থাকায় হাদীছটি ছহীহ; ছহীহ মুসলিম, হা/২২০৪; মিশকাত, হা/৪৫১৫।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭০৭; মিশকাত, হা/৪৫৭৭।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৭১; ছহীহ মুসলিম, হা/২২২১।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৭৩; মিশকাত, হা/৪৫৭৭।
[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৩২; মিশকাত, হা/২২২৮।
[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪৮; মিশকাত, হা/২৫৯৪।