আসুন আমরা সূরা নূরের ৫৫নং আয়াতে আল্লাহ তায়া’লা আমাদের ‘খিলাফত ব্যবস্থাটা কিভাবে গড়ে উঠবে’ এবং ‘কোন ভিত্তিপ্রস্তরের ওপরে খেলাফতটা টিকে থাকবে’ তা তিনি যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, সেটা নিয়ে একটু পর্যালোচনা করে দেখি।
আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা আয়াতটাকে ৩ ভাগে ভাগ করে নিচ্ছি। এবার আয়াতটা ধীরেসুস্থে মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
١۔وَعَدَ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَیَسۡتَخۡلِفَنَّہُمۡ فِی الۡاَرۡضِ کَمَا اسۡتَخۡلَفَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ۪
১.তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে এ মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে যমীনের প্রতিনিধিত্ব (খেলাফত) প্রদান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব (খেলাফত)প্রদান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে,
٢۔ وَلَیُمَکِّنَنَّ لَہُمۡ دِیۡنَہُمُ الَّذِی ارۡتَضٰی لَہُمۡ وَ لَیُبَدِّلَنَّہُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ خَوۡفِہِمۡ اَمۡنًا ؕ
২.এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য তাদের দীনকে শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতি শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন,
٣۔یَعۡبُدُوۡنَنِیۡ لَا یُشۡرِکُوۡنَ بِیۡ شَیۡئًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ بَعۡدَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ﴿۵۵﴾
৩.তারা আমারই ইবাদাত করবে, আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। আর এরপর যারা কুফরী করবে তারাই ফাসিক।[সূরা নূর-৫৫]
এখন আমরা দেখবো আল্লাহ তায়া’লা কিভাবে আয়াতটাকে স্টেপ বাই স্টেপ বর্ণনা করেছেন।
#প্রথম_ভাগে, ‘কিভাবে খেলাফতটা গড়ে উঠবে’ সেই দিকে ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ তায়া’লা বলছেন যে তিনি ঐসকল লোকদেরকেই খেলাফত দেওয়ার ওয়াদা করেছেন, যারা ‘ঈমান’ আনবে এবং ‘আমলে ছলেহ’ করবে।
আমরা সকলেই মোটামুটি আল্লাহর প্রতি ‘ঈমান কিভাবে আনতে হবে’ তা জানি। কিন্তু এই ‘আমলে ছলেহ’ নিয়ে সবাই তো নয় ই, বরং তা কমসংখ্যক লোকই জানে।
খেয়াল করে দেখুন যে আল্লাহ কিন্তু এখানে শুধু ‘আমল’ বলেননি। বরং বলেছেন ‘আমলে ছলেহ’। তার মানে আপনি যেসকল ‘আমল’ করবেন তা ‘চলেহ’ তথা সৎ ও সঠিক হওয়াও জরুরি। বাংলায় বললে যেটা শুধু ‘কর্ম’ নয়, বরং ‘সৎকর্ম’ হয়। এবং আল্লাহ তায়া’লা ক্বুরআনের যত জায়গায় এই কর্মের কথা উল্লেখ করেছেন, তত জায়গায় তিনি শুধু ‘আমল’ উল্লেখ করেননি, বরং ‘আমলে ছলেহ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
তো আন্ধভাবে নিজের ইচ্ছা মত, মনগড়া যুক্তিতর্ক দিয়ে ‘আমল’ করলে হবে না। সেই আমল হতে হবে ‘ছলেহ’ তথা সৎ ও সঠিক আমল। আর এখানেই ‘সুন্নাতে রাসূলে’র ভূমিকা। অর্থাৎ আমল কিভাবে করলে সেটা ‘আমলে ছলেহ’ হবে, তা শুধু আপনি ‘সুন্নাতে রাসূলে’র মাধ্যমেই পাবেন। আমলটা ‘আমলে ছলেহ’ হবার জন্য এটাই একমাত্র পথ ও পন্থা। এখানে আমল করার অন্য কোনো পথ ও পন্থা চলবে না। যখন আপনি ‘সহীহ্ হাদীস ও সুন্নাতে রাসূলে’র ভিত্তিতে ‘আমল’ করবেন, তখনই সেটা আল্লাহ তায়া’লার কাছে ‘আমলে ছলেহ’ বলে গন্য হবে এবং তখনই কেবল তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে। এটাই হচ্ছে ‘আমলে ছলেহে’র পরিচয়।
আর এর বাহিরে গিয়ে যখনই আপনি নিজের মত করে কোনো ‘আমল’ করবেন, তখনই তা হয়ে যাবে ‘বিদআতি আমল’। এর থেকে বুঝা যাচ্ছে ‘চলেহ-হীন’ আমলই হচ্ছে ‘বিদআতি আমল’। রাসূল (সা) বলেছেন, “প্রতিটা বিদআত ই গোমরাহি, আর গোমরাহির স্থান হচ্ছে জাহান্নামে”। অতএব যে আমল রাসূল (সা) এর সহীহ্ হাদীস ও সুন্নাহভিত্তিক হবে, সেটাই হবে ‘আমলে ছলেহ’।
তাহলে কি দাঁড়ালো? ‘খেলাফত ব্যবস্থা’ বাস্তবায়িত হবার জন্য শিরক মুক্ত ঈমান যেমন থাকতে হবে, তেমনি বিদআত মুক্ত আমল তথা ‘আমলে ছলেহ’ও থাকতে হবে। থাকতে হবে মানে থাকতেই হবে। অতএব সুন্নাহ বহির্ভূত কোনো ‘আমল’ যেমন কবুল হবে না, বরং বাতিল হবে, তেমনি ওসব মনগড়া বিদআতি বাতিল আমল দিয়ে ‘ইসলামি খেলাফত’ও কায়েম হবে না।
এভাবেই শিরকমুক্ত ঈমান এবং বিদআতমুক্ত আমল তথা ‘আমলে ছলেহ’ যখন আমরা করতে পারবো, তখনই আল্লাহ তায়া’লা আমাদেরকে ‘খেলাফতে’র উপযুক্ত করে দিবেন। এমতাবস্থায় তিনি আমাদেরকে তা দেওয়ার অঙ্গীকারও করেছেন এবং বলেছেন যেভাবে পূর্ববর্তীদেরকে দেওয়া হয়েছে ঠিক সেভাবে আমাদেরকেও এই ‘খেলাফত’ দেওয়া হবে।যেমন তিনি ইউসুফ (আ), সুলায়মান (আ), এবং যুলক্বরনাইনকে খেলাফত তথা রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছিলেন।
#দ্বিতীয়_ভাগে, আল্লাহ তায়া’লা বলছেন যে এই ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি হবার পর, তিনি এই ‘দ্বীনি-খেলাফত’কে শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিবেন এবং ‘ভয়-ভীতি’কে ‘শান্তি ও নিরাপত্তা’য় পরিণত করে দিবেন। এই ‘শক্তিশালী এবং নিরাপত্তা’র অবস্থাটা কেমন হবে, তা বুঝার জন্য আমরা যদি ‘খোলাফায়ে রাশীদুনে’র যুগটা দেখি তাহলেই আমরা তা বুঝতে পারবো। তাঁদর খেলাফতি রাষ্ট্র যেমন শক্তিশালী ছিলো, তেমনি শান্তি ও নিরাপত্তায় ছিলো পরিপূর্ণ। কেননা তাঁরা সর্ব প্রকারের শিরক, কুফরি ও বিদআত থেকে মুক্ত ছিলেন।
#তৃতীয়_ভাগে, ‘কোন ভিত্তিপ্রস্তরের ওপরে খেলাফতটা টিকে থাকবে’ সেটা নিয়েই আল্লাহ তায়া’লা বলেছেন। খেয়াল করে দেখুন যে খেলাফতটা যেমন শিরকমুক্ত ঈমান ও বিদআতমুক্ত আমলের ওপরে প্রতিষ্ঠিত হবে, ঠিক একইভাবে তা শিরকমুক্ত ইবাদতের ওপরেই টিকে থাকবে। তথা আল্লাহ তায়া’লা আয়াতের প্রথমে যেমন ঈমানের কথা বলেছেন( ব্যক্তি শিরক থেকে মুক্ত হয়েই ঈমান আনে), তেমনি শেষে এসেও একই কথা তথা শিরকমুক্ত ইবাদত এবং কুফরিমুক্ত জীবন যাপনের কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন যে (یَعۡبُدُوۡنَنِیۡ لَا یُشۡرِکُوۡنَ بِیۡ شَیۡئًا)। তথা সম্পূর্ণভাবে শিরক থেকে মুক্ত হয়েই তাঁর ইবাদত করে যেতে হবে। এখানে شَیۡئًا শব্দ দিয়ে যে কোনো ধরনের শিরকের মূলোৎপাটন করে দেওয়া হয়েছে। সামান্যতম শিরকও করা যাবে না।
এবং শুধু শিরক থেকেই মুক্ত নয়, বরং এরপর তিনি বলছেন যে (وَ مَنۡ کَفَرَ بَعۡدَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ)।তথা খেলাফত প্রতিষ্ঠার পর কোনো শিরক যেমন করা যাবে না, তেমনি কোনো কুফরি কাজ এবং কুফরি জীবনযাপনও করা যাবে না। তো আল্লাহ তায়া’লা শিরকমুক্ত ইবাদতের সাথে কুফরিমুক্ত জীবনের কথাও নিয়ে এসেছেন। যারা কুফরি করবে, তারা ফাসেক লোকে পরিণত হবে। আর অবশ্যই ফাসেক লোকেদের হাতে খেলাফত টিকে থাকতে পারে না।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে শিরকটা ইবাদতের সাথে সম্পর্কিত। আর কুফরিটা দৈনন্দিন জীবনের চলাফেরা, শাসন ব্যবস্থা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। যেমন আমাদের বর্তমান সমাজে পয়লা বৈশাখ, ভেলেন্টাইন্স-ডে, থার্টি-ফার্স্ট নাইট, ডেমোক্রেসি, সেক্যুলারিজম, কমিউনিজম, হিউম্যানিজম, ফ্যামিনিজম, লিবারেলিজম, সমকামী আন্দোলনসহ আরো অনেক কুফরি মতবাদে ছেঁয়ে গেছে। চারিদিকে শুধু কুফরি মতবাদ ও কুফরি কাজের ছড়াছড়ি। খেলাফত টিকে থাকার জন্য এসব কুফরি থেকেও সম্পূর্ণভাবে মুক্ত থাকতে হবে।
এই আয়াত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে ‘কিভাবে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে আর কিভাবে সেটা টিকে থাকবে’। এই প্রতিষ্ঠার জন্য এবং একি সাথে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদেরকে সকল ধরনের শিরকি ইবাদত, কুফরি জীবন ব্যবস্থা এবং বিদআতি আমল থেকে সম্পূর্নরুপে মুক্ত থাকতে হবে। অন্যথায় তা কেনোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হবে না। আবার যখন প্রতিষ্ঠিত হবে তখন আবার টিকেও থাকবে না, যদি না আমরা এসব থেকে মুক্ত থাকি।
বর্তমান পৃথিবী এবং মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাকালেই তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কেনো আজ আমাদের হাতে ক্ষমতা নেই। মুসলিম সমাজই আজ শিরকি ইবাদত, কুফরি জীবনযাপন এবং বিদআতি আমল দিয়ে ভরপুর। এবং ইসলামি দলগুলোর কর্মিরাও এসব থেকে মুক্ত নয়। তারাও কখনো ইসলামি হুকমত কায়েম করতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা এসব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হবে।
অতএব, এই তিন জায়গায় তথা শিরকি ইবাদত, কুফরি জীবনযাপন এবং বিদআতি আমলের সাথে কোনোভাবে কোনো মুসলিমের বিন্দু পরিমাণ আপোষ চলতে পারে না, যদি আমরা দুনিয়ায় খেলাফতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা চাই। কেউ আমল কম করুক, কিংবা অন্য কোনো গুনাহ করুক, কিন্তু এই তিন জায়গায় যখন ফাটল দেখা দিবে, তখন সবকিছুই অস্তমিত হয়ে যাবে। তখন জীবন হবে দিকবিদিকশুন্য। না থাকবে কোনো শক্তি, না থাকবে কোনো শান্তি, এবং না থাকবে জীবনের কোনো নিরাপত্তা।