“আল্লাহর একটি গুণ হচ্ছে, ‘মা‘য়িয়্যাত’ বা বান্দাদের সাথে থাকা” এ গুণটির বিষয়ে আলোচনা:
আল্লাহ তা‘আলার এই মহান সিফাত যা তিনি নিজের জন্য বেশ কয়েকটি আয়াতে সাব্যস্ত করেছেন, এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছেন তা যাতে স্পষ্টভাবে বয়ান করতে পারি তার জন্য আমি নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো গুরুত্বসহ উল্লেখ করছি:
প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের সঙ্গে থাকার বিষয়টি কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত একটি বিষয়। যেমন,
১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ﴾ [الحديد: ٤] আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। (সূরা আল হাদীদ: ৫৭: ৪)
২) ﴿ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّٱلَّذِينَ هُم مُّحۡسِنُونَ ١٢٨ ﴾ [النحل: ١٢٨] নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১২৮)
৩) আল্লাহ তা‘আলা ফেরআউনের কাছে পাঠাবার সময় মূসা ও হারুন আলাইহিমাস্সালামকে লক্ষ্য করে বলেন: ﴿ قَالَ لَا تَخَافَآۖ إِنَّنِي مَعَكُمَآ أَسۡمَعُ وَأَرَىٰ ٤٦ ﴾ [طه: ٤٦] তোমরা ভয় করো না। আমি তো তোমাদের সাথেই আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি’। (সূরা তাহা: ২০: ৪৬)
৪) তিনি তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে বলেন: ﴿ إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدۡ نَصَرَهُ ٱللَّهُ إِذۡ أَخۡرَجَهُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ثَانِيَ ٱثۡنَيۡنِ إِذۡ هُمَا فِي ٱلۡغَارِ إِذۡ يَقُولُ لِصَٰحِبِهِۦ لَا تَحۡزَنۡ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَاۖ﴾ [التوبة: ٤٠] “যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন যখন কাফিররা তাকে বের করে দিল, সে ছিল দু’জনের দ্বিতীয়জন। যখন তারা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিল, সে তার সঙ্গীকে বলল, ‘তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” (সূরা আত-তাওবা: ৪০)
৫) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: «أفضل الإيمان أن تعلم أن الله معك حيثما كنت» সর্বোত্তম ঈমান হলো এই যে, তুমি জানবে যে, তুমি যেখানেই আছ, আল্লাহ তোমার সাথেই আছেন। [তাবারানী, আল আওসাত (৮৮/৩৩৬), হাদীস নং ৮৭৯৬]
হাদীসটিকে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ্ ‘আল আকীদা আল ওয়াসেতিয়্যা’ গ্রন্থে হাসান বলেছেন। অবশ্য আলেমদের কেউ কেউ হাদীসটি দুর্বল বলেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর সাথে আছেন এ কথাটি ইতঃপূর্বে একটি আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। আর সালাফগণও এ ব্যাপারে ইজমা করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাখলুকের সঙ্গে আছেন।
দ্বিতীয়ত: এ ‘সঙ্গে থাকা’র বিষয়টি তার যে প্রকৃত অর্থ সে অর্থেই সত্য। তবে তা এমন ‘সঙ্গে থাকা’ যা আল্লাহর জন্য উপযোগী এবং যা এক মাখলুক কর্তৃক অন্য মাখলুকের সঙ্গে থাকার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়; কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজ সম্পর্কে বলেছেন: ﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١] তাঁর মত কিছু নেই, আর তিনি হলেন সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা। (সূরা আশ্-শূরা: ৪২: ১১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: ﴿هَلۡ تَعۡلَمُ لَهُۥ سَمِيّٗا ٦٥ ﴾ [مريم: ٦٥] তুমি কি তাঁর সমতুল্য কাউকে জান? (সূরা মারইয়াম: ১৯: ৬৫) তিনি আরো বলেন: ﴿ وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدُۢ ٤ ﴾ [الاخلاص: ٤] আর তাঁর কোনো সমকক্ষও নেই। (সূরা আল ইখলাস: ১১২: ৪)
সুতরাং ‘সঙ্গে থাকা’র সিফাত অন্যান্য সিফাতের মতোই প্রকৃত অর্থেই আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত, আল্লাহর ক্ষেত্রে যেভাবে উপযোগী সেভাবে। আর তা মাখলুকের সিফাতের সাথে সাদৃশ্যবিহীন।
ইবনে আবদুল বার বলেছেন, ‘আহলে সুন্নত কুরআন-সুন্নাহয় উল্লিখিত সকল সিফাতের ওপর ঈমান আনা এবং সেগুলোকে রূপক অর্থে নয় বরং প্রকৃত অর্থে বহন করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবে তারা এ সিফাতসমূহের কোনোটারই ধরণ কী বা বাস্তবতা কী তা উল্লেখ করেন না। [ইমাম ইবনুল বার এর বরাত দিয়ে এ কথাটি ইমাম ইবনে তাইমিয়া তার গ্রন্থ আল ফাতওয়া আল হামাওয়িয়ায় উল্লেখ করেন, দ্রঃ মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৫, পৃ. ৮৭]
ইমাম ইবনে তাইমিয়া আল ফাতওয়া আল হামাওয়িয়ায় বলেন, ‘কোনো ধারণাকারী এটা ধারণা করতে পারে না যে, কুরআন সুন্নাহয় যা এসেছে তার একটির সঙ্গে অপরটির সংঘর্ষ হতে পারে। যেমন কেউ বলল যে, আল্লাহর কিতাবে ও রাসূলের সুন্নাহয় আল্লাহ তা‘আলার আরশের উপরে থাকার যে কথা এসেছে, তার বাহ্যিক অর্থ আগত আয়াতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ﴿وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ﴾ [الحديد: ٤] আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। (সূরা আল হাদীদ: ৫৭: ৪) অথবা নিম্নবর্ণিত হাদীসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, আর তা হলো: «إذا قام أحدكم إلى الصلاة فإن الله قبل وجهه» “যখন তোমাদের কেউ সালাতে দাঁড়ায় তখন আল্লাহ তা‘আলা নিশ্চয় তাঁর সম্মুখেই থাকেন।” এবং এ জাতীয় অন্যান্য হাদীস। বস্তুত এরকম মনে করাটা ভুল; কারণ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সঙ্গে প্রকৃত অর্থেই আছেন এবং তিনি আরশের ওপরও প্রকৃত অর্থে আছেন। আল্লাহ তা‘আলা এ উভয় বিষয়কে নিম্নবর্ণিত আয়াতে একত্র করে উল্লেখ করেছেন: ﴿ هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ يَعۡلَمُ مَا يَلِجُ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا يَخۡرُجُ مِنۡهَا وَمَا يَنزِلُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ وَمَا يَعۡرُجُ فِيهَاۖ وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٤ ﴾ [الحديد: ٤] “তিনিই আসমানসমূহ ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি জানেন জমিনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু বের হয়; আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়। আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। (আল হাদীদ: ৫৭: ৪)
এখানে তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে তিনি আরশের উপরে আছেন এবং প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবহিত এবং আমরা যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসুল আও‘আলে বলেছেন: «والله فوق العرش، وهو يعلم ما أنتم عليه» “আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপরে, তবে তোমরা যে অবস্থায় আছ সে ব্যাপারে তিনি সম্যক অবগত।
এর ব্যাখ্যায় বলা যায় যে, আরবী ভাষায়مع (সঙ্গে) শব্দটি যখন ব্যবহৃত হয় তখন এর বাহ্যিক অর্থ হয় সাধারণভাবে তুলনা করা, যা আবশ্যিকভাবে পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ অথবা একে অন্যের ডানে বা বামে থাকাকে দাবি করে না। যদি ‘সঙ্গে থাকা’র অর্থকে বিশেষ কোনো অর্থে সীমিত করে উল্লেখ করা হয়, তবে তা সে বিশেষ অর্থ-কেন্দ্রিক তুলনাকে বুঝাবে। বলা হয় যে, আমরা এখনও চলছি আর চাঁদ আমাদের সঙ্গে, অথবা তারকা আমাদের সঙ্গে। আরও বলা হয় যে ‘এ বস্তুটি আমার সঙ্গে’ যদিও তা আপনার মাথার ওপরে। কেননা আপনার উদ্দেশ্য হলো এ বস্তুর সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা বর্ণনা করা। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলাও প্রকৃত অর্থেই তাঁর মাখলুকের সঙ্গে আছেন যদিও তিনি প্রকৃত অর্থেই তাঁর ‘আরশের উপরে আছেন।” [মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৫, পৃ. ১০২]
তৃতীয়ত: আল্লাহ কর্তৃক মাখলুকের সঙ্গে থাকার দাবি হলো, তিনি তাঁর ইলম ও ক্ষমতায়, শ্রবণ ও দর্শনে, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণে এবং রুবুবিয়াতের অন্যান্য অর্থে মাখলুককে পরিবেষ্টন করে আছেন। যদি ‘সঙ্গে থাকা’ বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা গুণকে কেন্দ্র করে উল্লিখিত না হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ﴿وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ﴾ [الحديد: ٤] আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। (আল হাদীদ: ৫৭: ৪) আরও বলেছেন, ﴿مَا يَكُونُ مِن نَّجۡوَىٰ ثَلَٰثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمۡ وَلَا خَمۡسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمۡ وَلَآ أَدۡنَىٰ مِن ذَٰلِكَ وَلَآ أَكۡثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمۡ أَيۡنَ مَا كَانُواْۖ﴾ [المجادلة: ٧] “তিন জনের কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থজন হিসেবে আল্লাহ থাকেন না, আর পাঁচ জনেরও হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি থাকেন না। এর চেয়ে কম হোক কিংবা বেশি হোক, তিনি তো তাদের সংগেই আছেন। (সূরা আল মুজাদালা: ৫৮: ৭)
আর যদি ‘সঙ্গে থাকা’র বিষয়টি বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা গুণকে কেন্দ্র করে উল্লিখিত হয়, তখন উল্লিখিত অর্থগুলোর সঙ্গে যোগ হবে- সাহায্য সহযোগিতা করা, তাওফীক দেওয়া এবং সঠিক পথ দেখানো।
আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক বিশেষ কোনো ব্যক্তির সঙ্গে থাকার উদাহরণ হলো মূসা ও হারূন আলাইহিমাস্ সালামকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলার কথা: ﴿لَا تَخَافَآۖ إِنَّنِي مَعَكُمَآ أَسۡمَعُ وَأَرَىٰ ٤٦ ﴾ [طه: ٤٦] “আমি তো তোমাদের সাথেই আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি। (সূরা তাহা: ২০: ৪৬) অনুরূপ তাঁর বাণী, ﴿لَا تَحۡزَنۡ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَاۖ ﴾ [التوبة: ٤٠] “তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (আত-তাওবা: ৪০)
বিশেষ কোনো গুণের সঙ্গে থাকার উদাহরণ হলো, আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ٤٦ ﴾ [الانفال: ٤٦] “আর তোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সূরা আল আনফাল: ৪৬) আল কুরআনে এ জাতীয় আরো বহু উদাহরণ রয়েছে।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ্ ‘ফাতওয়া আল হামাওয়িয়া’তে বলেন, ‘প্রসঙ্গের ভিন্নতা অনুযায়ী ‘সঙ্গে থাকা’র ভিন্ন ভিন্ন হুকুম হয়ে থাকে। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যখন বলেন: ﴿يَعۡلَمُ مَا يَلِجُ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا يَخۡرُجُ مِنۡهَا وَمَا يَنزِلُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ وَمَا يَعۡرُجُ فِيهَاۖ وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٤ ﴾ [الحديد: ٤] “তিনি জানেন জমিনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু বের হয়; আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়। আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। (আল হাদীদ: ৪) এই বাণীর বাহ্যিক অর্থ যা নির্দেশ করছে তা হলো, এই ‘সঙ্গে থাকা’র হুকুম ও দাবি হলো, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবহিত, তিনি তোমাদের ওপর সাক্ষী এবং তিনি তোমাদের ওপর আধিপত্যকারী ও তোমাদের ব্যাপারে জ্ঞানী। এটাই হলো সালাফদের কথার অর্থ যে: তিনি তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে তোমাদের সঙ্গে আছেন। আর এটাই হলো উল্লিখিত বাণীর বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থ।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ্ আরও বলেন: যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাহাড়ের গুহায় তাঁর সাথীকে বললেন: ‘তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’ তখন এটাও তার বাহ্যিক অর্থেই এবং অবস্থার পারিপার্শ্বিকতা থেকে বুঝা যায় যে, এখানে ‘সঙ্গে থাকা’র অর্থ সম্যকভাবে অবহিত থাকা, সাহায্য-সহযোগিতা করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ﴿ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّٱلَّذِينَ هُم مُّحۡسِنُونَ ١٢٨ ﴾ [النحل: ١٢٨] “নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১২৮) অনুরূপভাবে মূসা ও হারূন আলাইহিমাস্ সালামকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿ قَالَ لَا تَخَافَآۖ إِنَّنِي مَعَكُمَآ أَسۡمَعُ وَأَرَىٰ ٤٦ ﴾ [طه: ٤٦] “ভয় করোনা, আমি তো তোমাদের সাথেই আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি’। (সূরা তাহা: ২০: ৪৬) এখানে ‘সঙ্গে থাকা’ বাহ্যিক অর্থেই। আর এসব স্থলে সঙ্গে থাকার অর্থ হলো: সাহায্য-সহযোগিতা।
পরিশেষে ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, ‘সঙ্গে থাকার অর্থ ও তার চাহিদার মধ্যে পার্থক্য আছে। আর হতে পারে যে, যা সঙ্গে থাকার চাহিদা তাই তার অর্থ, যা স্থানভেদে ভিন্ন হয়।’ [মাজমুউল ফাতাওয়া, পৃ. ১০৩]
মুহাম্মাদ ইবনুল মুওসিলী ইমাম ইবনুল কাইয়েম র. এর গ্রন্থ استعجال الصواعق المرسلة على الجهمية والمعطلة এর নবম উদাহরণে (পৃষ্ঠা নং ৩০৯) বলেন: مع (সঙ্গে) শব্দটি যে অর্থ বুঝায় তা হলো সঙ্গ দেওয়া, সম্মতি জ্ঞাপন করা। অতএব যদি সাধারণভাবে বলা হয় যে, আল্লাহ তাঁর মাখলুকের সঙ্গে আছেন, তবে এর দাবিগত আবশ্যিক অর্থ হবে, তিনি তাঁর মাখলুক বিষয়ে সম্যক অবহিত, তিনি তাদের রক্ষণা-বেক্ষণ করছেন এবং তিনি তাদের ওপর ক্ষমতাবান। আর যদি বিশেষভাবে বলা হয়, যেমন নিম্নোক্ত আয়াতে: ﴿ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّٱلَّذِينَ هُم مُّحۡسِنُونَ ١٢٨ ﴾ [النحل: ١٢٨] “নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১২৮) তাহলে তার দাবিগত আবশ্যিক অর্থ হবে, আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য- সহযোগিতা ও সমর্থনদানের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আছেন।
অতএব আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দার সঙ্গে থাকা দুই প্রকার: সাধারণভাবে সঙ্গে থাকা এবং বিশেষভাবে সঙ্গে থাকা। আর আল কুরআনে উভয় প্রকারের কথাই উল্লিখিত রয়েছে।
ইমাম নাওয়াওয়ী রচিত ‘চল্লিশ হাদীস’ গ্রন্থের ঊনিশ নম্বর হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে রজব রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন যে, ‘বিশেষভাবে সঙ্গে থাকার দাবি হলো, আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য, সমর্থন, সুরক্ষা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সঙ্গে থাকেন। আর সাধারণভাবে সঙ্গে থাকার অর্থ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞান, অবগত থাকা এবং তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে থাকেন।’
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ্ সূরায়ে মুজাদালায় ‘সঙ্গে থাকা বিষয়ক’ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,‘এ কারণেই একাধিক আলেম এ ব্যাপারে ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন যে, এখানে সঙ্গে থাকার অর্থ ‘জ্ঞানের মাধ্যমে সঙ্গে থাকা’। এ অর্থ নেওয়ার বিষয়টি সন্দেহাতীত। তবে জ্ঞান ও দৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তার মাখলুকের সঙ্গে থাকার পাশাপাশি তিনি শ্রবণের মাধ্যমেও তাদের পরিবেষ্টন করে আছেন। অতএব আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টিকুল সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত এবং তাদের কোনো কিছুই তাঁর কাছে অদৃশ্য নয়।’
চতুর্থত: আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের ‘সঙ্গে থাকা’ এটা দাবি করে না যে তিনি তাদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন, অথবা তিনি তাদের স্থানে অবস্থান করছেন। এটা কোনোভাবেই বোঝায় না। কেননা এ জাতীয় অর্থ বাতিল অর্থ যা আল্লাহর ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য নয়। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী এমন অর্থবোধক হতে পারে না যা আল্লাহর ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য হতে পারে না।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ্ তাঁর ‘আল আকীদা আল ওয়াসেতিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন,‘তিনি তোমাদের সাথে আছেন’ এর অর্থ এটা নয় যে তিনি মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন। ভাষার ব্যবহার পদ্ধতি এ অর্থকে আবশ্যক করে না। বরং চাঁদ আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন এবং তার সৃষ্টিসমূহের মধ্যে ছোট্ট একটি সৃষ্টি। চাঁদ আকাশে স্থাপিত এবং তা মুসাফির এবং অমুসাফির সবার সঙ্গেই আছে, সে যেখানেই থাক না কেন।’
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তাসহ মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন বা মাখলুকের সঙ্গে অবস্থান করছেন এটি হলো ‘সঙ্গে থাকা’র বাতিল অর্থ। এ বাতিল অর্থটিকে প্রাচীন জাহমিয়া সম্প্রদায় ও অন্যান্য কিছু সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কেউ বলেনি। এই জাহমিয়া সম্প্রদায় বলেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তাসহ সকল স্থানে আছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ কথা থেকে পবিত্র ও ঊর্ধ্বে। ‘বড় মারাত্মক কথা, যা তাদের মুখ থেকে বের হয়। মিথ্যা ছাড়া তারা কিছুই বলে না!’ (সূরা আল কাহ্ফ: ১৮: ৫)
তাদের এ কথাকে সালাফগণ অস্বীকার করেছেন। ইমামগণ অস্বীকার করেছেন; কেননা এ কথার এমন কিছু বাতিল দাবি আছে যা আল্লাহ তা‘আলাকে অপূর্ণাঙ্গ বলে গুণান্বিত করে। আল্লাহ তা‘আলা যে মাখলুকের ঊর্ধ্বে আছেন তা অস্বীকার করে।
কোনো ব্যক্তি এটা কি করে বলতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তাসহ সকল স্থানে আছেন অথবা তিনি তাঁর মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র মহান যিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন: ﴿وَسِعَ كُرۡسِيُّهُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَۖ﴾ [البقرة: ٢٥٥] “তাঁর কুরসী আসমানসমূহ ও জমিন পরিব্যাপ্ত করে আছে। (সূরা আল বাকারা: ২: ২৫৫) আরও বলেছেন, ﴿وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعٗا قَبۡضَتُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَٱلسَّمَٰوَٰتُ مَطۡوِيَّٰتُۢ بِيَمِينِهِۦۚ﴾ [الزمر: ٦٧] “অথচ কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবীই থাকবে তাঁর মুষ্টিতে এবং আকাশসমূহ তাঁর ডান হাতে ভাঁজ করা থাকবে। (সূরা আয্-যুমার: ৩৯: ৬৭)
পঞ্চমত
এই ‘সঙ্গে থাকা’ আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের ঊর্ধ্বে থাকা এবং আরশের উপরে থাকার সাথে সাংঘর্ষিক নয়; কেননা আল্লাহ তা‘আলার জন্যে নিরঙ্কুশ ঊর্ধ্বতা প্রমাণিত, হোক তা সত্তাগত অথবা সিফাতগত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿وَهُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡعَظِيمُ ٢٥٥ ﴾ [البقرة: ٢٥٥] “আর তিনি সুউচ্চ, মহান। (সূরা আল বাকারা: ২: ২৫৫) তিনি অন্যত্র বলেন: ﴿ سَبِّحِ ٱسۡمَ رَبِّكَ ٱلۡأَعۡلَى ١ ﴾ [الاعلى: ١] “তুমি তোমার সুমহান রবের নামের তাসবীহ পাঠ কর। (সূরা আল আলা: ৮৭: ১) অন্য এক আয়াতে এসেছে: ﴿وَلِلَّهِ ٱلۡمَثَلُ ٱلۡأَعۡلَىٰۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٦٠ ﴾ [النحل: ٦٠] “আল্লাহর জন্য রয়েছে মহান উদাহরণ। আর তিনিই পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ৬০)
আর কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, আকল এবং ফিতরতের দলিল এ ব্যাপারে একত্র হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্বোর্ধ্বে।
এ ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহর দলিল তো গুণে শেষ করার মতো নয়। যেমন: ﴿فَٱلۡحُكۡمُ لِلَّهِ ٱلۡعَلِيِّ ٱلۡكَبِيرِ ١٢ ﴾ [غافر: ١٢] “অতএব হুকুম কেবল আল্লাহ তা‘আলার যিনি সুউচ্চ, সুমহান। (গাফের: ৪০: ১২) অনুরূপ, ﴿ وَهُوَ ٱلۡقَاهِرُ فَوۡقَ عِبَادِهِۦۚ﴾ [الانعام: ١٨] “আর তিনিই তাঁর বান্দাদের উপর ক্ষমতাবান। (সূরা আল আনআম: ৬: ১৮) অনুরূপ, ﴿ أَمۡ أَمِنتُم مَّن فِي ٱلسَّمَآءِ أَن يُرۡسِلَ عَلَيۡكُمۡ حَاصِبٗاۖ فَسَتَعۡلَمُونَ كَيۡفَ نَذِيرِ ١٧ ﴾ [الملك: ١٧] “যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের উপর পাথর নিক্ষেপকারী ঝড়ো হাওয়া পাঠানো থেকে তোমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছ? (সূরা আল মুলক: ৬৭: ১২), তদ্রূপ, ﴿ تَعۡرُجُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ إِلَيۡهِ﴾ [المعارج: ٤] “ফেরেশতাগণ ও রূহ ঊর্ধ্বগামী হয় আল্লাহর পানে। (সূরা আল মাআরিজ: ৭০: ৪) অনুরূপ, ﴿ قُلۡ نَزَّلَهُۥ رُوحُ ٱلۡقُدُسِ مِن رَّبِّكَ﴾ [النحل: ١٠٢] “বল, রুহুল কুদস (জীবরীল) একে (কোরআন) তোমার রবের পক্ষ হতে নাযিল করেছেন। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১০২) এ জাতীয় আরো বহু আয়াত।
আর হাদীস থেকে দলিল হলো- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: «ألا تأمنوني وأنا أمين من في السماء» “তোমরা কি আমাকে বিশ্বস্ত ভাববে না, আর আমি হলাম যিনি আকাশে আছেন তার বিশ্বস্ত। আরও বলেছেন, «والعرش فوق الماء، والله فوق العرش» “আরশ হলো পানির উপর, আর আল্লাহ হলেন আরশের উপর। [তাবারানী, আল কাবীর (৯/২২৮); ইবনে খুযায়মা, আত-তাওহীদ : হাদীস নং ৬৪৯ এবং ১৫০; বাইহাকী, আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ. ৪০১; আয-যাহাবী, আল উলুউ, পৃ. (৬৬৪); ইবনুল কাইয়েম তার ‘ইজতিমাউল জুয়ুশ আল ইসলামিয়া’ গ্রন্থে এ হাদীসটি সহীহ বলেছেন, পৃ. (১০০)] তদ্রূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, «ولا يصعد إلى الله إلا الطيب» “উত্তম ব্যতীত অন্যকিছু আল্লাহর পানে ঊর্ধ্বারোহণ করে না। [বুখারী তাওহীদ অধ্যায়, হাদীস নং (৭৪২৯)] অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস থেকে আরেকটি উদাহরণ হলো, আরাফার দিন আকাশের দিকে ইশারা করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, اللهم اشهد (হে আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন।) অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরাম যখন স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীনের বিধান পৌঁছে দিয়েছেন, তখন তাদের এ স্বীকারোক্তির ওপর আকাশের দিকে ইশারা করে আল্লাহ তা‘আলাকে সাক্ষী থাকতে বলেছিলেন। তদ্রূপ হাদীস থেকে আরেকটি উদাহরণ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা এক দাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলেছিল, তিনি আসমানে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ কথাকে মেনে নিয়ে বললেন: তাকে আযাদ করে দাও, সে মুমিনা। এ ছাড়াও আরো অন্যান্য হাদীস।
অনুরূপভাবে বিষয়টিতে ইজমাও বর্ণিত আছে। ইজমার ব্যাপারে বলা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার সর্বোর্ধ্বতার ব্যাপারে একাধিক আলেম ইজমা সম্পন্ন হওয়ার কথা বলেছেন।
তাছাড়া বিষয়টি বিবেকের দাবী, আল্লাহ তা‘আলার সর্বোর্ধ্বতার ব্যাপারে আকল বা যুক্তিগত দলিল হলো এই যে, সর্বোর্ধ্বতা হলো পূর্ণাঙ্গতাবাচক একটি গুণ, আর নিম্নতা হলো অপূর্ণাঙ্গতাবাচক একটি গুণ। আর আল্লাহ তা‘আলা পূর্ণাঙ্গতার গুণে গুণান্বিত এবং অপূর্ণাঙ্গতার গুণ থেকে পবিত্র।
তদ্রূপ এ বিষয়টি ফিতরাত্ব তথা স্বাভাবিক প্রকৃতিরও দাবী। ফিতরাতের দলিল হলো: এমন কোনো দো‘আ-প্রার্থনাকারী নেই আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকার সময় যার অন্তরাত্মা ঊর্ধ্বমুখি হয় না, যদিও কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে তার কোনো পড়াশোনা না থাকে, যদিও কোনো শিক্ষক তাকে শিখিয়ে না থাকে।
সুতরাং অকাট্য দলিলের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার জন্য প্রমাণিত এই ঊর্ধ্বতার সাথে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মাখলুকের সঙ্গে থাকার কোনো সংঘর্ষ নেই। উপরে যা বর্ণিত হয়েছে সেগুলো ছাড়াও আরও কয়েকটি কারণ আমরা এখানে বর্ণনা করতে পারি:
প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে- যা বৈপরীত্য থেকে মুক্ত – এ দুটি বিষয়কে নিজের জন্য একত্র করে উল্লেখ করেছেন। অতএব এ দুটি যদি সাংঘর্ষিক হতো তবে আল কুরআন এ দুটোকে একত্র করে উল্লেখ করত না।
আর আল কুরআনের কোনো বিষয় যদি আপনার কাছে বৈপরীত্যপূর্ণ বলে মনে হয়, তাহলে তা বারবার ঘেঁটে দেখুন, যতক্ষণ না আপনার কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে না যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿ أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَيۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخۡتِلَٰفٗا كَثِيرٗا ٨٢ ﴾ [النساء: ٨٢] “তারা কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হত, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত। (সূরা আন্-নিসা: ৪: ৮২)
দ্বিতীয়ত: ‘সঙ্গে থাকা’ এবং উচুতে থাকা সৃষ্টিবস্তুর জন্যেও সম্ভব। যেমন চাদ। অতএব কেউ যদি রাতের বেলায় পথ চলার সময় বলে আমরা এ অবস্থায় চলছি যে, এখনো চাদ আমাদের সঙ্গেই আছে, তবে এটাকে বিপরীতমুখী কথা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হবে না। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যারা পথ চলে তারা জমিনে, আর চাদ হলো আকাশে। অতএব যদি একটি মাখলুখের ক্ষেত্রে এরূপ সম্ভব হয় তবে যিনি সৃষ্টিকর্তা তাঁর ক্ষেত্রে এরূপ কেন সম্ভব হবে না। ‘বরং চাদ আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন, সে আল্লাহর ছোট্ট মাখলুকের মধ্যে একটি। সে মুসাফির এবং অমুসাফিরের সঙ্গে আছে তারা যেখানেই থাক না কেন।’ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ্ এর এ কথার ব্যাখ্যায় শাইখ মুহাম্মদ খালীল আল হাররাস বলেন, ‘তিনি চাদের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়েছেন যা আকাশে স্থাপিত। চাদ মুসাফির ও অমুসাফির সবার সঙ্গেই আছে, তারা যেখানেই থাক না কেন। যদি এটা চাদের বেলায় সম্ভব হয় যা আল্লাহ তা‘আলার ছোট্ট মাখলুকের মধ্যে একটি, তাহলে যিনি সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবহিত, যিনি তাঁর বান্দাদের সকল বিষয় জানেন এবং তাদের সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান, যার হাতে আকাশ ও পৃথিবী ও সমগ্র মহাবিশ্ব ঠিক আমাদের হাতে থাকা ছোট্ট একটি গুটির মতো, তাঁর ব্যাপারে কি এটা বলা ঠিক হবে না যে তিনি তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে আছেন যদিও তিনি তাদের ঊর্ধ্বে, তাদের থেকে আলাদা এবং আরশের উপরে?’[শায়খ মুহাম্মদ খালীল আল হাররাস, শারহুল আকীদা আল ওয়াসেতিয়া, পৃ. ১১৫]
তৃতীয়ত: যদি ধরে নিই যে ঊর্ধ্বতা এবং সঙ্গে থাকা এ দুটি বিষয় কোনো মাখলুকের ক্ষেত্রে একত্র হওয়া সম্ভব নয়, তবে এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় না যে, তা সৃষ্টিকর্তার ক্ষেত্রেও অসম্ভব; কারণ আল্লাহ তা‘আলা হলেন উদাহরণহীন। তাঁর মতো কোনো জিনিস নেই। ﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١] “তাঁর মত কিছু নেই, আর তিনি হলেন সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা আশ-শূরা:১১) [দেখুন, মুহাম্মদ ইবনে আমীন আশ্শানকিতী, আদওয়াউল বয়ান, ——]
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ্ আল আকীদা আল ওয়াসিতিয়া গ্রন্থে বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মাখলুকের নিকটতা ও সঙ্গে থাকার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহয় যা এসেছে তা আল্লাহর সর্বোর্ধ্বতা ও সর্বোচ্চতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়; কারণ সকল গুণের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা হলেন উদাহরণবিহীন। তিনি নিকটে থাকা সত্ত্বেও সর্বোর্ধ্বে, কাছে থাকা সত্ত্বেও সর্বোচ্চতায়।’ [মুহাম্মাদ খালীল হাররাস, শারহুল আকীদা আল ওয়াসেতিয়া, পৃ. ১১৬]
এ বিষয়ে খোলাসা কথা হলো:
১. আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের সঙ্গে থাকার কুরআন, সুন্নাহ এবং সালাফদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।
২. সঙ্গে থাকার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার জন্য উপযোগিভাবে প্রকৃত অর্থেই এবং তা কোনো মাখলুক কর্তৃক অন্যকোনো মাখলুকের সঙ্গে থাকার সদৃশ নয়।
৩. আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দাদের সঙ্গে থাকার দাবি হলো, তিনি তাদের পরিবেষ্টন করে আছেন তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা দ্বারা, শ্রবণ ও দর্শন দ্বারা, আধিপত্য ও ব্যবস্থাপনা দ্বারা এবং রুবুবিয়াতের অন্যান্য অর্থে, যদি সঙ্গে থাকার বিষয়টি অনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত হয়। আর যদি সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি অথবা গুণের সঙ্গে থাকার কথা উল্লিখিত হয় তখন ওপরে বর্ণিতভাবে সঙ্গে থাকার পাশাপাশি সাহায্য-সমর্থন করা, তাওফীক ও সঠিক পথ দেখানো ইত্যাদিও সঙ্গে থাকার অর্থে সন্নিবিষ্ট হবে।
৪. সঙ্গে থাকা এটা দাবি করে না যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে থাকেন অথবা তাদের স্থলে অবস্থান করেন। ‘সঙ্গে থাকা’ কোনোভাবেই এ অর্থ বুঝায় না।
৫. ওপরে যা বর্ণিত হলো তা যদি অনুধাবন করে দেখি তবে আমরা জানতে পারি যে, আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রকৃত অর্থে তাঁর মাখলুকের সঙ্গে থাকা এবং প্রকৃত অর্থে আরশের ওপরে থাকা এ দুয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। পবিত্র মহান আল্লাহ তা‘আলা যার প্রশংসা করে আমরা শেষ করতে পারব না, তিনি নিজে যেভাবে নিজের প্রশংসা করেছেন তিনি ঠিক সে রকমই। সালাত ও সালাম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল সাহাবীর প্রতি।
আল্লাহর মুখাপেক্ষী মুহাম্মাদ সালেহ আল উছাইমীন কর্তৃক রচিত।
তারিখ: ২৭/১১/১৪০৩ হিজরী
বাংলা অনুবাদ: শাইখ মুহাম্মাদ শামসুল হক্ক সিদ্দিক
অনুবাদ সম্পাদনা: প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া