وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ
وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ
অর্থঃ এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।(সুরা বাকারাঃ আয়াত নং-১৫৫)
আমরা জীবন চলার পথে কত স্বপ্ন দেখি, কত পরিকল্পনা করি। জীবনকে সাজাতে কত আয়োজনে মত্ত থাকি। আধুনিক বস্তুবাদী সভ্যতায় তো জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়, (যদিও বা আমরা জীবনের উদ্দেশ্য সম্মন্ধে বে-খেয়াল থাকি) আর সে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে পরিকল্পনা করি, পরিকল্পণা বাস্তবায়নে জীবনপাত করি। আমরা কেউ স্বপ্ন দেখি ডাক্তার হবো, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবো, কেউ বা বিজ্ঞানী হবো। আবার কেউ বা রাজনীতিবিদ হয়ে দেশ সেবার লক্ষ্য নির্ধারণ করি। পরিস্থিতির সাপেক্ষে কারো কারো লক্ষ্য হয়, জীবন ধারনের জন্য শুধু মাত্র দু মুঠো অন্নের সংস্থান করা। শরীয়ত সম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ দোষের কিছু নয় বরং প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু আমরা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করি, সেখানে কি সবসময় পৌছতে পারি? কিংবা যে পরিকল্পণা করি, তা কি বাস্তবায়ন করতে পারি? এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি অধিকাংশ সময়ই জীবন আমাদের পরিকল্পণা অনুযায়ী চলেনা। তবে অনেকে আছেন, যারা পরিকল্পণা অনুযায়ী লক্ষ্য অর্জন করেন, জীবনকে সাফল্য (!) মন্ডিত করেন। এদের মধ্যে অনেকে সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করে নিজের মেধা, সামর্থ্য, যোগ্যতা, কর্মস্পৃহার প্রতি এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে যে, নিজেকেই তার সফল জীবনের স্থপতি হিসাবে দাবী করে। প্রকৃত পরিকল্পণা কারী আল্লাহকে ভুলে যায়। আবার যারা লক্ষ্য অর্জনে ব্যার্থ হয়, তাদের অনেকেই হতাশায় এতটাই মুষড়ে পড়ে যে, তাদের কাছে জীবনের গতি স্তব্ধ হয়ে আসে, তারা কক্ষচ্যুত হয়ে পড়ে, অনেক সময় এই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে নানা-রকম নেশায় ডুবে যায়, নানা অপরাধ মূলক কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে, জীবনটা তাদের কাছে হয়ে যায় জুয়া খেলার বস্তু। তারাও তাদের জীবনের প্রকৃত পরিকল্পণা কারী আল্লাহকে ভুলে যায় এবং সকল প্রকার মানবীয় গূণাবলী বিসর্জন দিয়ে শয়তানের ক্রিড়নকে পরিণত হয়। পরিশেষে তারা রূপান্তরিত হয় নরকের কিটে। জীবন নিয়ে এই রকম চরমপন্থা মূলক অবস্থান একজন মুমিন বা মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একজন মুমিন তার জীবন পরিচালনার জন্য পরিকল্পণা করবে, চেষ্টা বা অধ্যবসায়ে নিজেকে নিয়োজিত করবে, তবে তার সবটুকু হবে হালাল পন্থায়, শরীয়তের বিধি-বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে। উদাহরণ স্বরুপ একজন ব্যাবসায়ী ব্যাবসায় উন্নতি করে ধনী হতে চায়। ধনী হওয়া ইসলামে কোনো অপরাধ নয়, তবে তার উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ তার ধন-সম্পদ আল্লাহ সুবহানু তাআ’লার সন্তষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যায়িত হবে। এই ধন উপার্জনের প্রচেষ্টায় কখনো অসদুপায় অবলম্বন করা যাবেনা, ব্যবসাটি হতে হবে হালাল পণ্যের, ওজনে কম দেয়া যাবেনা, সুদের সাথে যুক্ত থাকা যাবেনা ইত্যাদী। সে সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করবে। কখনো ব্যবসায় লোকসানের কারণে কপর্দক শুন্য হয়ে গেলেও নিরাশ হওয়া যাবেনা। সে শুধু চেষ্টা করতে পারে, কিন্ত চেষ্টাকে ফলপ্রসু করার মালিক একমাত্র আল্লাহ সুবহানুতাআ’লা। সে যেটি অর্জন করতে চেয়েছে তা যদি সে পেয়ে যায়, সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে। আর যদি না পায় তাহলে জানবে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছে, আর তার জন্য আল্লাহর কোনো কল্যাণকর পরিকল্পনা রয়েছে। সে কখনো হতাশ হয়ে আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে শয়তানের পাতা ফাঁদে পা দেবেনা। সেই ব্যক্তিই মুসলমান, যে নিজের ইচ্ছা কে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পন করে আত্ম-সমর্পনকারী হয়ে যায়। সে জানে, জীবন চলার পথে নানা ভাবে আল্লাহ তাকে পরীক্ষা করতে পারেন। আর এ পরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার উপায় হলো সবর ও তাওয়াক্কুল। উপরে উল্লেখিত সুরা বাকারার ১৫৫ আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন বলেছেন।
আল্লাহ আরো বলেনঃ
أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ
অর্থঃ মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?
وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
অর্থঃ আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে।(সুরা আনকাবুতঃ আয়াত নং২-৩)
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
অর্থঃ আমি পৃথিবীস্থ সব কিছুকে পৃথিবীর জন্যে শোভা করেছি, যাতে লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে।(সুরা কাহাফঃ আয়াত নং-৭)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ সুবহানুতাআ’লা বলেনঃ
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَنَبْلُوكُم بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ
অর্থঃ প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।(সুরা আম্বিয়াঃ আয়াত নং-৩৫) আল-কুরানুল কারীমের এ রকম অনেক আয়াতে আল্লাহ সুবহানুতাআ’লা মানব জাতিকে পরীক্ষার কথা ব্যাক্ত করেছেন। পরিশেষে সবরকারী ও আল্লাহর উপর ভরসাকারিরাই সফলকাম হবে।
মানুষের নিকট আপাত দৃষ্টিতে যা ক্ষতিকর, তা প্রকৃত পক্ষে হতে পারে তার জন্য মংগল জনক। এ প্রসঙ্গে মুসা আলাইহিসসালাম ও খিজির আলাইহিসসালাম এর মধ্যকার ঘটনাটি স্মরন করা যেতে পারেঃ
فَانطَلَقَا حَتَّى إِذَا رَكِبَا فِي السَّفِينَةِ خَرَقَهَا قَالَ أَخَرَقْتَهَا لِتُغْرِقَ أَهْلَهَا لَقَدْ جِئْتَ شَيْئًا إِمْرًا
অর্থঃ অতঃপর তারা চলতে লাগলঃ অবশেষে যখন তারা নৌকায় আরোহণ করল, তখন তিনি তাতে ছিদ্র করে
দিলেন। মূসা বললেনঃ আপনি কি এর আরোহীদেরকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্যে এতে ছিদ্র করে দিলেন? নিশ্চয়ই আপনি একটি গুরুতর মন্দ কাজ করলেন। (সুরা কাহাফঃ আয়াত নং-৭১)
খিজির আলায়হিসসালাম কর্তৃক নৌকা ছিদ্র করা আপাত দৃষ্টিতে মন্দ কাজ ছিল, তাই মুসা আলায়হিসসালাম এর প্রতিবাদ করেছিলেন, কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি যে, উক্ত কাজটি তিনি (খিজির আলায়হিসসালাম) আল্লাহর নির্দেশে করেছেন।
কিন্তু ছিদ্র করার কারণ জানার পর উক্ত কাজটি মুসা আলায়হিসসালাম এর কাছে আর মন্দ থাকেনি, কিংবা যে কোন বিবেচক ব্যক্তির কাছে তা ভালো কাজ বলে বিবেচিত হবে।
أَمَّا السَّفِينَةُ فَكَانَتْ لِمَسَاكِينَ يَعْمَلُونَ فِي الْبَحْرِ فَأَرَدتُّ أَنْ أَعِيبَهَا وَكَانَ
وَرَاءهُم مَّلِكٌ يَأْخُذُ كُلَّ سَفِينَةٍ غَصْبًا
অর্থঃ নৌকাটির ব্যাপারে-সেটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষন করত। আমি ইচ্ছা করলাম যে, সেটিকে ক্রটিযুক্ত করে দেই। তাদের অপরদিকে ছিল এক বাদশাহ। সে বলপ্রয়োগে প্রত্যেকটি নৌকা ছিনিয়ে নিত।(সুরা কাহাফঃ আয়াত নং-৭৯)
নবী রসুলরা এই দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশী পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু তারা সবর করেছেন আল্লাহর পরিকল্পণার উপর ভরসা করেছেন ফলে তারা পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছেন। তাওয়াককুল অর্থ আল্লাহর উপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়, বরং নিজের সাধ্যের মধ্যে পরিকল্পণা করে, বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া,
কিন্তু ফলাফল আল্লাহর হাতে এটা বিশ্বাস করা। কথায় আছে, “আগে উটটি খুঁটিতে বাঁধ তারপর আল্লাহর উপর ভরসা কর”। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তার পরিবারের জন্য এক বছরের খাদ্য সংগ্রহ করতেন, অতঃপর কখনো কখনো গরীব-দুঃখীদের মধ্যে দান করে এক সপ্তাহেই তা শেষ করে ফেলতেন। হিজরতের নির্দেশ প্রাপ্ত হওয়ার পর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রাজিয়াল্লাহু আনহুকে তা জানান। আবু বকর রাজিয়াল্লাহু আনহু দুইটি উট খরিদ করে গোপণে গোপণে মরুভুমির যাত্রার উপযোগী করে গড়ে তুলতে থাকেন। এক সময় পরিকল্পনা অনুসারে তিনি যখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর সাথে করে হিজরতের উদ্দেশ্যে সাওর পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করেন। তাদের খোঁজে মক্কার মুশরিকদের পায়ের আওয়াজে, আবু বকর রাজিয়াল্লাহু যখন তটস্থ হয়ে পড়েন, তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাকে সান্তনা দেন যে, তাদের সাথে আল্লাহ আছেন, সুতরাং ভয়ের কোনো কারণ নেই। এরপর তিনি (রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) নিশ্চিন্তে গুহার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। আল্লাহর পরিকল্পণা বাস্তবায়িত হয়, তারা সুষ্ঠু ভাবে মদীনায় পৌছতে সমর্থ হন।অনেকে বলে থাকেন, কথায় কথায় নবী-রসুলের কাহিনী আনেন কেন? তারা ছিলেন আল্লাহর পছন্দনীয় প্রিয় বান্দা, তাই তারা এ রকম কঠিন পরিস্থিতি সহজে মোকাবেলা করেছেন, আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্য এ সব সম্ভব নয়। তারা ভুলে যান যে, নবী-রসুলকে আল্লাহ সুবহানুতাআ’লা মানব জাতির অনুসরণের জন্যপাঠিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ছিলেন ‘উসওয়াতুন হাসানা’ মানব জাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ, তাঁর অনুসরণের মধ্যেই মানবতার মুক্তি নিহিত।
এবার একজন সাধারণ মানুষের গল্প শুনি। হিজরী ৫ম শতকের কথা, আবু বকর আনসারী ১ নামক এক ব্যক্তি জীবিকার অন্বেষনে হন্যে হয়ে মক্কার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, কিন্তু কোথাও তিনি কর্মের সংস্থান করতে পারছিলেননা। দিনের পর দিন যখন মক্কার অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে ব্যার্থ-পরিশ্রান্ত, তখন রাস্তার মাঝখানে ছোট একটি থলে কুড়িয়ে পান। থলেটি নিয়ে তিনি তার ঘরে ফিরে আসেন, থলে খুলে তিনি চমকিত হন এবং দেখতে পান মূল্যবান রত্ন –খচিত একটি নেকলেস। নেকলেসটি দেখে ক্ষণিকের জন্য খুশী হলেও আল্লাহ ভীরু আবু বকর বুঝতে পারেন এই মহা মূল্যবান রত্ন খচিত হারটির মালিক তিনি নন। সুতরাং এর মালিককে খুঁজে বের করার বাড়তি দায়িত্ব তাঁর কাঁধে চেপে বসে। নেকলেসটি ঘরে রেখে আবার তিনি মক্কার রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েন। এ দিকে তিনি শুনতে পান যে, এক বৃদ্ধ ব্যাক্তি ঘোষনা করছেন যে, একটি নেকলেস সহ তার থলে হারিয়ে গেছে, যে ব্যাক্তি এর সন্ধান দিতে পারবে তাঁকে তিনি পাঁচশত দিনার পুরস্কার দেবেন। তিনি লোকটির কাছে এগিয়া যান এবং বলেন, তিনি এ রকম নেকলেস সহ একটি থলে কুড়িয়ে পেয়েছেন, তবে উপযুক্ত প্রমাণ দিতে পারলে তিনি তা ফিরিয়ে দেবেন। বৃদ্ধটি যখন নেকলেসের স্বঠিক বর্ণনা প্রদান করেন, তখন সে তার ঘর থেকে থলেটি এনে বৃদ্ধের হাতে অর্পন করেন। বৃদ্ধ যখন তার ঘোষিত পুরস্কারের অর্থ যুবক আবু বকরকে প্রদান করতে চান, তখন তিনি তা গ্রহণে অস্বীকার করেন, কেননা এ অর্থ তিনি উপার্জন করেননি, শুধু মাত্র মালের প্রাপ্য মালিককে তার হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছেন। পাঁচশত দিনার তখন প্রায় নিঃস্ব আবু বকরের কাছে অনেক অর্থ, কিন্তু তিনি শুধু তার উপার্জিত অর্থই গ্রহণ করতে চান। অনেক চাপা-চাপির পর যখন তিনি অর্থ কোনোমতেই নিতে রাজী হননা, তখন বৃদ্ধ নিরাশ হয়ে তার গন্তব্যে যাত্রা করেন। এরপর অনেকদিন হয়ে গেলেও আবু-বকর মক্কায় জীবিকা অর্জনে তেমন সুবিধা করতে ব্যার্থ হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন আল্লাহর এই প্রশস্থ পৃথিবীর অন্য কোথাও জীবিকার সন্ধানে যাবেন। তিনি একটি জাহাজে উঠে বসেন, কিন্তু তার পরীক্ষা তখনো শেষ হয়নি, হঠাৎ কোনো কারনে জাহাজ ডুবে যায়, অনেক যাত্রী পানিতে ডুবে মৃত্যু বরণ করেন, তিনি জীবন রক্ষার তাগিদে পানিতে ঝাঁপ দেন এবং অবলম্বন স্বরূপ আল্লাহর রহমতে ভাঙ্গা জাহাজের একটি কাষ্ঠ খন্ড পান। এই কাষ্ঠ খন্ড ধরে ভাসতে ভাসতে তিনি একটি দ্বীপে এসে পৌছান। ক্লান্ত, ক্ষুধার্থ আবু বকর তীরে পৌঁছে কাউকে দেখতে পাননা, শুধু দুরে একটি মসজিদের অবয়ব দেখেন। তিনি ক্লান্ত দেহে মসজিদে পৌছে দেখেন তা শুন্য , শুন্য মসজিদে বসে তিনি কোরান তেলাওয়াত শুরু করেন। কোরান তেলাওয়াতের অপূর্ব আওয়াজে আসে পাশের লোকালয় থেকে মানুষজন মসজিদে এসে জড়ো হয়, তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন “আপনি কুরান জানেন?” তিনি উত্তরে হ্যাঁ বললে, তারা বলে, “আমাদের এখানে কেউ কুরান জানেনা, আপনি আমাদের কুরান শিক্ষা দিন, আমরা আপনাকে পারিশ্রমিক দেব।” তিনি তাদের কুরান শিক্ষা দিতে সম্মত হন, তার কাছে তখন সমানে অর্থ ও উপঢৌকন আসতে থাকে। এভাবে কিছু দিন চলার পর, তিনি মসজিদে কিছু মুসহাফ ( আল-কুরানুল কারীমের পাতা) দেখতে পান, তিনি তা নিয়ে পড়া শুরু করেন। মুসহাফ থেকে কুরান পড়া দেখে স্থানীয় মানুষ জন তাকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি লিখতে ও পড়তে পারেন?” তিনি হ্যাঁ সুচক উত্তর দেয়ার পরে তারা বলে, “আমরা এখানে কেউ লিখতে ও পড়তে পারিনা, আমাদের আপনি লিখা-পড়া শিখান, আপনাকে আমরা উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেব।” তিনি তাদের লিখা-পড়া শেখাতে থাকেন। আরো অধিক পরিমাণে অর্থ-বিত্ত তার কাছে আসতে থাকে, এ দিকে সবাই তার নম্র, মাধুর্যপুর্ণ ব্যাবহারে মুগ্ধ, তিনি সবার প্রিয় পাত্রে পরিণত হন।
এদিকে দ্বীপ-বাসী বুঝতে পারেন, ভীন দেশী এই যুবক তাদের মাঝে বেশী দিন থাকবেন না, শীঘ্রই হয়ত অন্য কোনো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। তারা তাকে সেখানে স্থায়ী ভাবে রাখার পরিকল্পণা করতে থাকে। তারা সবাই মিলে তার কাছে যায় এবং সেখানকার সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তির এতিম মেয়ে, যে কিনা এক পরমা সুন্দরী, তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। আবু বকর বুঝতে পারেন, দ্বীপ-বাসী তাকে সেখানে স্থায়ী ভাবে রাখার পরিকল্পণা করছে , তাই তিনি তাদের প্রস্তাবে প্রথমে অসম্মতি জ্ঞাপন করে, পরে তাদের অনুনয় ও পিড়াপিড়িতে বিয়ে করতে সম্মত হন। যথা সময়ে নির্দিষ্ট সেই পাত্রীর সাথে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর যখন নববধুকে তার সামনে নিয়ে আসা হয়, তিনি প্রথমে কণের পায়ের পাতার দিকে তাকান, তার পরে আস্তে আস্তে উপরের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতে থাকেন, তার দৃষ্টি যখন গলার কাছে আসে, সেখানে তার দৃষ্টি আটকে যায় এবং পরক্ষণে তিনি তার বিস্মিত দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকান। উপস্থিত জনতার মধ্যে রোল ওঠে, বরের কণে পছন্দ হয়নি, তাই তিনি তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছেন, নববধুও তখন সবার সামনে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়াতে রাগে, দুঃখে ও লজ্জায় কাঁদতে থাকে।তার এরূপ অদ্ভুত আচরণের কারণে যে এমন নাজুক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা আবু বকর বুঝতে পারেন, তখন তিনি সবার উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা কেউ ভুল বুঝবেননা, কণে আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমি অন্য একটি কারণে এমন আচরণ করেছি, আমি যখন তার গলার দিকে তাকাই, তখন তার গলায় যে মূল্যবান নেকলেসটি ছিল, তা দেখে হতভম্ব হয়ে যায়, কারণ তা ছিল আমার পরিচিত। এই সেই নেকলেস যা আমি একদিন মক্কায় এক বৃদ্ধকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।” তখন তিনি নেকলেস সংক্রান্ত ঘটনাটি পূর্বাপর বলেন। উপস্থিত জনতা তখন তাঁকে জানান যে, তার স্ত্রী সেই বৃদ্ধেরই কন্যা, যিনি কিছুদিন আগে গত হয়েছেন এবং তিনি এই দ্বীপের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি সব সময় তার গল্প করতেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন যে, সেই নেক যুবকের সাথে সে যেন তার কন্যার বিয়ে দিতে পারেন। আজ আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেছেন।
এরপর এই দ্বীপে তাদের নতুন সংসার শুরু হয়। একে একে তিনি দুই পুত্র সন্তানের পিতা হন এবং সুখে- শান্তিতে বাস করতে থাকেন। কিন্তু তার এই সুখ বেশীদিন স্থায়ী হয়না, তিনি আবার পরীক্ষার সম্মুখীন হন।
তার স্ত্রী ও দুই সন্তান মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে। এরপর তিনি উত্তরাধিকার সুত্রে স্ত্রীর সম্পত্তির মালিক হন, তিনি পরবর্তিতে সেই নেকলেসটি বিক্রি করেন, যার মূল্য ছিল পাঁচ হাজার দিনার। আল্লাহর পরিকল্পণার উপর ভরসাই তাকে সেদিন এ অবস্থানে নিয়ে আসে। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে পার্থিব জীবনে সাফল্য লাভ করাই পরীক্ষায় উত্তির্ন হওয়া নয়। মুমিনের পরীক্ষায় উত্তির্ণ হওয়ার মাপকাঠি হচ্ছে, সবর ও তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে পরীক্ষা সম্পন্ন করা, প্রকৃত সাফল্যতো পরকালীন, সেই সাফল্যের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা।এবার বর্তমান কালের একটি গল্প শুনি, আপনারা হয়ত বর্তমান যুগের বিশিষ্ট দায়ী ও ইসলামী বক্তা ইউশা ইভান্স এর নাম শুনেছেন। তিনি একজন ধর্মান্তরিত আমারিকান মুসলমান। ১৯৯৮ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের দুই বছর পরের ঘটনা, তার অর্থনৈতিক অবস্থা তখন বড়ই সঙ্গীন, শুধুমাত্র ক্ষুধা নিবারনের জন্য তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন। এই সময় তিনি ফ্লোরিডার ছোট একটি শহরে এক নির্মাণ স্থাপনায় শ্রমিকের কাজ পান, তার কাজ ছিলো নিজ হাতে করে কংক্রিটের ভারী খন্ডকে বহন করা, অনভ্যস্ত ইউশা’র জন্য কাজটি খুবই কঠিন ছিল, তার হাতে ফোসকা পরার মত অবস্থা হয়েছিল, কিন্তু খুন্নি বৃত্তির জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো সুযোগ তার হাতে ছিলনা। এর মধ্যে এক শুক্রবার এলো, যা জুম্মার সালাতের দিন। তিনি তার বসকে জানালেন, আজ লাঞ্চের পর তার আসতে এক ঘন্টা দেরী হবে, কারণ তিনি জুম্মার সালাত আদায় করতে যাবেন। তার বস এ কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, সে বলে সে যদি লাঞ্চের পরে সময়মত কাজে উপস্থিত না হতে পারে, তাহলে তাকে কাজ থেকে বাদ দেয়া হবে। ইউশা ইভান্স তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, এটা ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয় যে, ইচ্ছা তিনি করলেই জুম্মার সালাত বাদ দিতে পারেন, তাকে যে কোনো ভাবে যেতেই হবে। লাঞ্চ ব্রেকের সময়, সে তার সব কিছু নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যত কে সামনে রেখে সেখান থেকে বেড়িয়ে পড়েন, যাবার আগে তার বসকে ঠিকানা দিয়ে যান, যাতে করে তার কাছে এক সপ্তাহের পারিশ্রমিকের চেক পাঠিয়ে দিতে পারেন।
জুম্মার সালাত সম্পন্ন হওয়ার পর তার সাথে এক ফিলিস্তিনি ধনী ব্যাবসায়ীর পরিচয় হয়, যার ফিলিস্তিন এবং আমেরিকা উভয় দেশেই পিজ্জার দোকান রয়েছে। ঐ ভদ্রলোক সরাসরি তাকে তার ছেলের পিজ্জার দোকানে কাজের জন্য প্রস্তাব করেন, তিনি সানন্দে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী দুই বৎসর ঐ পিজ্জার দোকানে নির্মান স্থাপনার চেয়ে দ্বিগুণ বেতনে কাজ করেন।
এটি শুধু আবু বকর বা ইউশা ইভান্সের ঘটনা নয়, সকল মুমিন যারা আল্লাহর উপর ভরসা করেন, তাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য। মানবেতিহাসে এ রকম ঘটনা একত্রে সন্নিবেশিত করে হয়ত অনেক বড় কলেবরের বই লিখা সম্ভব হবে!
আল্লাহ সুবহানুতাআ’লা কুরানুল কারীমে বলেনঃ
الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُواْ إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ
অর্থঃ যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।
أُولَـئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَـئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
অর্থঃ তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত।(সুরা বাকারাঃ আয়াত নং ১৫৬-১৫৭)
কৃতজ্ঞতাঃ ইউশা ইভান্স
১. ইমাম আযযাহাবী তার আল আসলাম আন নুবালা গ্রন্থে তাঁর কথা উল্লেখ করেছে। আব্দুল মালেক মুজাহিদ তার Gems & Jewels গ্রন্থে এই গল্পটি লিপিবদ্ধ করেছেন।