بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيم
ভাষার উৎপত্তি কীভাবে হলো? – কোনো স্বর্গীয় নির্দেশনার মাধ্যমে? – না কি মনুষ্য উদ্ভাবিত?- যুগ যুগ ধরে মানুষ এই প্রশ্নের উপর যথেষ্ট বিতর্ক করেছে। বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, কথা বলার ভাষা হলো আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত। এর প্রমাণ আল্লাহর ওহী, যা প্রয়োজনীয় যুক্তি দ্বারা সমর্থিত।
ওহী ভিত্তিক প্রমাণ হলো, মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَعَلَّمَ آدَمَ الأَسْمَاء كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلاَئِكَةِ فَقَالَ أَنبِئُونِي بِأَسْمَاء هَـؤُلاء إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ
আর আল্লাহ তা’আলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্য হয়ে থাকো।
(সুরা বাকারা, ২ : ৩১)
যৌক্তিক প্রমাণ নিচে দেয়া হলোঃ
কথা বা ভাষার নিয়মাবলী যদি প্রত্যক্ষভাবে মানুষ প্রতিষ্ঠা করে, তা হলে তা করতে তাদের প্রয়োজন হবে মানসিক সক্ষমতা, যুক্তিযুক্ত শৃঙ্খলা, বিস্তৃত জ্ঞান, এবং পৃথিবীতে প্রাপ্ত সকল কিছুর ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং তাদের সীমাবদ্ধতা, সাদৃশ্য, পার্থক্য এবং প্রকৃতি বা ধরন সম্পর্কিত জ্ঞান। তথাপি আমরা আবশ্যিকভাবেই জানি, একজন মানুষের পৃথিবীতে আগমণ করা এবং এইরূপ যোগ্যতা অর্জন করার মাঝে অনেক গুলো বছর থাকে, যেখানে তাকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়, তার প্রয়োজন হয় অন্যের পরিচর্যার এবং বিরূপ পরিবেশ থেকে প্রতিরক্ষার। জন্মের বহু বছর পরে একজন ব্যক্তি স্বনির্ভর হয়। পিতা-মাতা, দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, সেবিকা-পরিচারিকা কারোরই কোনো উপায় নেই তাকে সাহায্য করবে, যদি তাদের কোনো ভাষা না থাকে, যার মাধ্যমে তারা একে অপরের প্রয়োজন বুঝতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের কর্ষন, পশুপালন এবং ফসল ফলানো কার্যাবলী অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে, কী উপায়ে তারা নিজেদের ঠান্ডা ও গরম থেকে রক্ষা করবে, কী প্রতিরক্ষার মাধ্যমে হিংস্র ও বন্য জন্তু- জানোয়ার থেকে নিজের সুরক্ষা দেবে। সেই সাথে কী চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করবে। প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিকে বাল্যকালের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, যে সময়ের অক্ষমতা ও পরনির্ভরতার কথা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।
এ ছাড়াও, ভাষাকে অস্তিত্বে এনে বিধি-বদ্ধ করার পূর্ব শর্ত হচ্ছে, এমন একটি সময় থাকতে হবে, যখন কোনো ভাষা থাকবে না। ঐ সকল মানুষ এটি অস্তিত্বে আসার কারণ হবে, যাদের কার্য কলাপের মাধ্যমে ভাষার জন্ম হবে। কিন্তু পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে কার্যাবলী সাধন করতে কথা-বার্তার প্রয়োজন হবে। যদি তাদের নিজস্ব কোনো ভাষাই না থাকে, তাহলে কীভাবে ঐ সকল ব্যাক্তি-বর্গ যারা একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতর দিয়ে ভাষাকে অস্তিত্ব আনার কাজ করবে? এটি একটি অসম্ভব অবস্থা।
যৌক্তিক প্রমাণের পর আবশ্যিকভাবে এ কথাটি আসে যে, মানবজাতি অস্তিত্বে এসেছে অনস্তিত্ব থেকে। সাক্ষ্য-প্রমাণ নির্দেশ করে যে, সৃষ্টিকর্তা শুধু একজন। সাক্ষ্য-প্রমাণ এটাও নির্দেশ করে যে, নবুয়ত ও রিসালাত সত্য। এটি এই কারণে যে, মানুষ কথোপকথন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। কথোপকথন বর্ণ-মালার উচ্চারণ ও কিছু কর্মের সমন্বয়ে গঠিত হয়, যে কর্ম সম্পন্ন করতে কিছু কর্তার প্রয়োজন। প্রত্যেক কর্ম শুরুর একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, কর্ম প্রবণতা থেকে উদ্ভূত এক প্রকার আন্দোলন। এর থেকে এটিও সত্যায়িত হয় যে, বর্ণমালার উচ্চারণ গঠনের একটি শুরু আছে আর মানব জাতি কথা ছাড়া টিকতে পারেনা। যখন কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব দ্বিতীয় কোনো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল থাকে যার কোনো একটি শুরু আছে, তখন প্রথম বিষয়েরও শুরু থাকতে বাধ্য।
সুতরাং, এটি সত্য যে, অবশ্যই একটি জিনিসের অস্তিত্ব আসার পর অপর জিনিস অস্তিত্বে এসেছে। মানুষ যা কিছু সর্ব প্রথম (ভাষার) জেনেছে, তা স্রষ্টার কাছে থেকেই জেনেছে। যেহেতু ভাষা প্রকৃতিগতভাবেই এমন একটি বিষয়, যা শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই জানতে হয়। আর সে কারণেই, ভাষার প্রথম শিক্ষক যিনি, তিনি সরাসরি আল্লাহর কাছে থেকেই শিখেছেন। অতঃপর যা তিনি তাঁর রবের কাছে থেকে শিখেছেন, তিনি পর্যায়ক্রমে তা তাঁর স্বজাতির অন্যান্য সদস্যদেরকে শিখিয়েছেন।
নিয়মাবলীর নির্ধারনের মাধ্যমে কোনো ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিধায়কদেরকে (যারা ভাষার নিয়মাবলী নির্ধারণ করবেন) পূর্ববর্তী কোনো একটি জ্ঞাত ভাষার নিয়মাবলীর বা কোনো সাংকেতিক পদ্ধতির জ্ঞান, যা তারা সবাই সাধারণভাবে ওয়াকিবহাল। তাদের সবাইকে ঐ সংকেতের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। যদি তারা এটি করার জন্য কোনো ভাষাকে ব্যবহার করে, তবেই তারা সমর্থ হবে । কোনো জিনিসের সংজ্ঞা ও ধরন সম্পর্কিত জ্ঞানের আদান প্রদান উচ্চারণের মাধ্যমে সম্ভব নয়, যদি না কোন ভাষা থাকে এবং সেই ভাষায় জ্ঞান ব্যাখ্যা না করা হয়। তাই অপর একটি ভাষা থাকা অতিব আবশ্যকীয়। এর থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, কথার উৎপত্তি মানুষের উদ্ভাবনের দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়।
অবশ্য এখনো একটি আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে, আর তা হলো ভাষা হচ্ছে সহজাত প্রবৃত্তি।
যৌক্তিকতার দাবি হচ্ছে, এই ধারণা মিথ্যা। প্রবৃত্তি শুধুমাত্র একটি ব্যাবহারের জন্য দায়ী হতে পারে, ভিন্নভাবে একত্রে অনেকগুলো ব্যবহারের জন্য নয়। কথামালা দ্বারা বাক্য গঠন একটি ঐচ্ছিক কর্ম, যা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে কৃত হয়। এই ধারণার (ভাষা হচ্ছে সহজাত প্রবৃত্তি) কোনো কোনো প্রস্তাবক কিছু বিভ্রান্তিকর যুক্তির অবতারণা করেন, আর তা হলো ভৌগলিক অবস্থানগত পার্থক্যের জন্য স্বভাবগত কারণেই বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে।
এটিও একটি অসম্ভব ধারণা। কারণ, ভাষার পার্থক্য যদি বিভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চলের পরিবেশের জন্য হয়, তা হলে একই অঞ্চলে একাধিক ভাষা থাকা সম্ভব নয়। আমরা আমাদের চোখেই দেখি যে, বাস্তবতা ভিন্ন। জনসাধারণের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বসতি স্থাপনের কারণে অধিকাংশ অঞ্চলেই একই সাথে একাধিক ভাষা বিদ্যমান। ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠী একই অঞ্চলে পাশাপাশি অবস্থান করেও ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। এই ধারণার অসারত্ব এখানেই প্রমাণিত হয়[1]। এ ছাড়াও পরিবেশ-প্রকৃতিতে কিছুই নেই যেখানে পানিকে ‘পানি’ নামেই ডাকতে হবে, একই বর্ণমালা দ্বারা গঠিত অন্য কোনো নামে নয়[2]। এক গুঁইয়ে স্বভাবের কেউ কেউ নিরলসভাবে তা দাবি করলে সে নিজেকে দুইটি সম্ভাব্য অবস্থানের একটিতে উপনীত করে। যথাঃ হয় সে একজন মিথ্যাবাদী অথবা মস্তিষ্কবিকৃত ব্যক্তি। অতএব বিশুদ্ধ অবস্থান হচ্ছে ভাষা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর আদেশ মারফত প্রাপ্ত, তাঁরই নির্দেশনা এবং তাঁরই শিক্ষা।
একইসাথে আমরা এটি অস্বীকার করিনা যে, আল্লাহর নির্দেশনাই প্রাপ্ত একটি ভাষা থেকে মানব জাতি অনেক ভাষার উদ্ভাবন করেছে। এর মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন জিনিসের প্রকৃতি, প্রকার ও সংজ্ঞা জেনেছে। আমাদের জানার কোনো উপায় নেই যে, আদম আলাইহিসসালাম কোন ভাষায় কথা বলেছেন। আমরা নিশ্চিতভাবে এটি বলতে পারি যে, সেই ভাষাটি ছিলো সকল ভাষার মধ্যে সর্বাধিক বিস্তারিত, প্রকাশে সর্বাধিক পরিস্কার, সবচেয়ে কম দ্যর্থবোধক, সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত এবং সবচেয়ে ব্যপক। এর শব্দভান্ডার ছিলো সর্বাধিক বিস্তৃত যাতে করে সকল বস্তুর, ঘটনা বা দুর্ঘটনার নাম ধারণ করতে পারে। মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَعَلَّمَ آدَمَ الأَسْمَاء كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلاَئِكَةِ فَقَالَ أَنبِئُونِي بِأَسْمَاء هَـؤُلاء إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ
আর আল্লাহ তা’আলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্য হয়ে থাকো।
(সুরা বাকারা, ২ : ৩১)
এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বীকৃতি যা এ বিষয়ে সকল সমস্যা ও মতভিন্নতা দূর করে দেয়।
কেউ কেউ বলেন যে, প্রথম ভাষা হলো সিরিয়াক। অন্যরা বলেন হিব্রু। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে, সিরিয়াক, হিব্রু এবং আরবী- শেষোক্তটি মুদার এবং রাবিয়াহ গোত্রের ভাষা। হিমায়ার ( প্রাচীন দক্ষিণ আরবের গোত্র) গোত্রের ভাষা নয়- এর প্রত্যেকটি মূলতঃ একই ভাষা , এবং যখন কোনো একই ভাষা ভাষী মানুষ ভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশে বসতি স্থাপন করে, তখন তাদের ভাষা নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, এবং তা খন্ডিত হয়ে যায়। এর উদাহরণ ঠিক এমন যে, যখন একজন আন্দালুসীয় কায়রোর আঞ্চলিক ভাষার মুখোমুখি হন, অথবা যখন কোনো খোরাসানি উপরে উল্লিখিত যে কোনো একটি ভাষার সংস্পর্শে আসেন। আমরা যখন ‘ফাস আল বালুত’[3] এর কোনো অধিবাসীর কথা শুনি, তখন আমাদের কাছে কর্ডোভার ভাষা থেকে প্রায় পৃথক কোনো ভাষা মনে হয়। একই পরিস্থিতি পৃথিবীর অন্য যে কোনো প্রান্তে দেখা যাবে। কারণ যখন কোনো অঞ্চলে এক সম্প্রদায়ের মানুষ ভিন্ন কোনো সম্প্রদায়ের বা গোত্রের মানুষের খুবই নিকটে বসবাস করে, তখন এমন ভাবে তাদের ভাষার পরিবর্তন হয় যা চিন্তাশীল সকলের কাছেই ধরা পড়ে।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, জনসাধারণ আরবী ভাষার শব্দ সম্ভারে এত সুস্পষ্ট পরিবর্তন এনেছে, তাদের শব্দমালা আদি শব্দমালা থেকে এত দূরে সরে এসেছে যে, মনে হয় সে গুলো অন্য ভাষার শব্দ। আমরা দেখি, তারা “ঈনাব” কে “ইনাব” ( আঙ্গুর), “আস্তূত” কে “সঅত” (চাবুক) এবং “ছালাছদা” কে “ছালাছাহ দানানীর” ( তিন দীনার) বলে। যখন একজন বারবার[4] আরবে পরিণত হন তখন তিনি “শাজারাহ” (গাছ) কে “সাজারাহ” বলেন। একজন গ্যালিশীয়[5] যখন আরবে পরিণত হন, তিনি “ ‘আইন ” এবং বড় “হা” উভয় বর্ণকে পরিবর্তন করে ছোট “হা” দিয়ে ‘মুহাম্মাদ’ উচ্চারণ করে। এটি খুবই সাধারণ ব্যাপার।
সুতরাং, যে ব্যাক্তি আরবী, হিব্রু এবং সিরিয়াক ভাষা নিয়ে অনুসন্ধান করেন, তিনি দেখতে পাবেন যে, এই তিনটি ভাষার মধ্যে পার্থক্য তেমনি, যেমনটি আমরা কিছু পূর্বে বর্ণনা করেছি। সুদীর্ঘ সময় ধরে মানুষের বিভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া, ভিন্ন ভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়ের সাথে বা নিকটে বসবাস করা এবং ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণের কারণে এই পরিবর্তনগুলো সাধিত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ভাষাত্রয় একই ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
এই ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠা করার পরে, আমরা বলি যে, সিরিয়াক ভাষা হচ্ছে হিব্রু এবং আরবী ভাষার পূর্বপুরুষ। সাধারণভাবে সবার মধ্যে এ ধারণা প্রচলিত আছে যে, এই আরবী ভাষায় প্রথম কথা বলেছেন ইসমাইল আলাইহিসসালাম এবং পরবর্তীতে তা তাঁর বংশধরদের ভাষায় পরিণত হয়। হিব্রু হচ্ছে ঈসহাক আলাইহিসসালাম এর বংশধরদের ভাষা। নিঃসন্দেহে সিরিয়াক হচ্ছে ইব্রাহীম আলাইহিসসালাম (আমাদের নবীর প্রতিও দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক) এর ভাষা। ঐতিহাসিকভাবে এই ব্যাপারে সবার মধ্যে একটি উঁচু পর্যায়ের ঐকমত্য আছে, তাই আমরা এই ধারণার উপরে সুদৃঢ়ভাবে থাকতে পারি। আর সে কারণেই সিরিয়াক হলো হিব্রু এবং আরবী উভয়েরই পূর্বপুরুষ।
কেউ কেউ এই দাবি করেছেন যে, গ্রীক হলো সরলতম ভাষা। তবে এই উক্তি সত্যি হলে তা বর্তমান সময়ের ( খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দী) জন্যই সম্ভব । কারণ এই ভাষার অনেক খানিই এখন হারিয়ে গেছে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও তাদের ভূখন্ড দখলের ফলে এই ভাষায় কথোপথনকারী মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ভাষাটি অনেক খানি সংকুচিত হয়ে গেছে। অথবা তাদের ভুখন্ডের অধিবাসীরা অন্য ভূখন্ডে অভিবাস গ্রহণ করে সেখানকার অধিবাসীদের সাথে মিশে যাওয়ার ফলেও এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একটি জাতির ভাষা, শিক্ষা ও ইতিহাস সংহত থাকে তাদের জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রব্যাবস্থার শক্তি, তাদের স্পন্দন এবং অবকাশের উপর।
ঐ সমস্ত জনগোষ্ঠী, যাদের রাষ্ট্র ধ্বংস হয়েছে, শত্রু দ্বারা যারা সম্পূর্ণ পরাভূত হয়েছে। যারা ভয়, ক্ষুধা, লাঞ্চনা নিয়ে ব্যতিব্যাস্ত থাকে। যারা শত্রুদের সেবায় সর্বদা নিয়োজিত থাকে। তাদের সৃষ্টিশীলতা মরে যায়। হতে পারে, এজন্যই গ্রীক জাতি তাদের ভাষা হারিয়েছে, ভুলে গেছে তাদের বংশ পরম্পরা ও ইতিহাস। তাদের বিজ্ঞান ধ্বংস হয়ে শূন্যগর্ভে পর্যবসিত হয়েছে। কার্যকারণ ও পর্যবেক্ষণ উভয়ের ভিত্তিতেই এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়। অ্যাসিরিয়া সম্রাজ্য কয়েক হাজার বছর আগে লোকচক্ষুর অন্তরালে এমনভাবে হারিয়ে গেছে যে, তাদের ভাষা আজ সম্পূর্ণ বিস্মৃত। এর থেকেই বোঝা যায়, অধিকাংশ ভাষা কালের গহবরে হারিয়ে যাওয়া কতই না সহজ। এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারিনা যে, মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম মানুষকে ভাষারই উত্তরাধিকারী করেছেন। তবে এমন ধারণা অসম্ভব নয় যে, আদি ভাষা যা, আদম আলাইহিসসালাম কে শিক্ষা দেয়া হয়েছিলো তা এমনভাবে হারিয়ে গেছে যে, তার কোনো চিহ্নই আজ আর নেই। অথবা এমনও হতে পারে যে, তা আজও টিকে আছে, কিন্তু তাকে চিহ্নিত করার কোনো উপায়ই আর নেই। এটা অনস্বীকার্য যে, কোনো একটি আদি ভাষা থাকতেই হবে। তবু এমনও হতে পারে, আমরা আজ যে ভাষাগুলোতে কথা বলি, আদম আলাইহিসসালামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার সবগুলোই শিখিয়েছেন। হতে পারে তখন একটি ভাষাই ছিলো কিন্তু তার অনেক সমার্থক শব্দ ছিলো যা দ্বারা কোনো একটি নির্দিষ্ট জিনিসকে নির্দেশ করা যেত। আর সেখান থেকেই পরবর্তীতে তাঁর বংশধরদের মধ্যে অসংখ্য ভাষার উদ্ভব হয়েছে। এটাই সবথেকে গ্রহণযোগ্য সম্ভাব্য দৃশ্যপট মনে হয়। যাই হোক, তা কখনোই নিশ্চিতভাবে জানার উপায় নেই। তবে আমরা নিশ্চয়তার সাথে এ কথা বলতে পারি, একটি আদি ভাষা রয়েছে, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষকে দান করেছেন।
আমি মনে করি যে, আল্লাহ সর্বপ্রথম যে ভাষা মানুষকে দান করেছেন তা বর্তমান কালে প্রচলিত সকল ভাষার সমন্বয়ে গঠিত ছিলো। আর তা থেকে আমার মধ্যে এই অনুভূতির জন্ম হয়েছে যে, যাদের একটি ভাষা বর্তমানে আছে তাদের নতুন করে আর একটি নতুন ভাষা সৃষ্টি করার জন্য কষ্ট করার কোনোই প্রয়োজন নেই। এটি হবে একটি নিদারুন অর্থহীন প্রচেষ্টা। কোনো বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই এ ধরনের অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব নিতে চাইবেন না। যদি এ ধরনের মানুষের অস্তিত্ব থেকেই থাকে, তা হলে তিনি হবেন অত্যধিক বাজে চিন্তার অধিকারী এবং বিচার-বুদ্ধিতে নিম্নস্তরের, যিনি কি না এমন জিনিস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন যার কোনো উপকারিতা নেই এবং একই সাথে তার জন্য যা খুবই বেশী প্রয়োজনীয় তাকে তিনি অবহেলা করেন- যেমন পরকালের চিন্তা-ভাবনা, দুনিয়াবী স্বার্থ, বিণোদন এবং উপকারী বিজ্ঞান।
এছাড়াও কিভাবে এমন ব্যক্তি তার দেশের সকল মানুষকে তাদের পরিচিত ভাষাকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য করবেন এবং তার উদ্ভাবিত ভাষা গ্রহণ করাবেন? আমি বলছিনা ব্যাপারটি একেবারেই অসম্ভব, তবে তা একেবারেই একটি দূরবর্তী সম্ভাবনা।
যদি কেউ এমন যুক্তি দেখান যে, বহু ভাষা ভাষী অধ্যুষিত রাজ্যের রাজা তার প্রজাদের শুধুমাত্র একটি মাত্র ভাষার ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ করতে চান। আমরা পালটা যুক্তি দিতে পারি যে, এটি বহু ভাষা উদ্ভাবনের বিপরীত অবস্থান, বরং ভাষা সংখ্যা হ্রাস করে শুধুমাত্র একটি ভাষা ফিরিয়ে আনার পদ্ধতি। এ ছাড়াও কেন একজন রাজা এমন একটি বহুবিধ সমস্যার ভেতর দিয়ে যাবেন, যেখানে তার জন্য অতিব সহজতর পদ্ধতি হচ্ছে তার প্রজাদের মধ্যে প্রচলিত কোনো একটি ভাষাকে অথবা তার জন্য ভালো যে, তার নিজের ভাষাকেই নির্বাচিত করবেন? বরং নতুন একটি ভাষা উদ্ভাবনের চেয়ে এটি হবে অনেক সহজ এবং যৌক্তিক। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
এমন লোকও আছে, যারা মনে করে, তার ভাষা অন্য ভাষার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এটি একটি নিরর্থক উক্তি, কারণ সবাই জানে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে কর্ম অথবা বিশেষ কোনো মর্যাদা। ভাষার কোনো কর্ম নেই আর নেই কোনো ওহী ভিত্তিক প্রমাণ যে, এটি অন্যান্য ভাষার উপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।
মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللّهُ مَن يَشَاء وَيَهْدِي مَن يَشَاء وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, পথঃভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন। তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।
(সূরা ইব্রাহীম, ১৪ : ৪)
তিনি আরো বলেনঃ
فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ
আমি আপনার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা স্মরণ রাখে।
(সূরা দুখান, ৪৪ : ৫৮)
সুতরাং, আল্লাহ আমাদের বলছেন যে, তিনি আরবী ভাষায় কুরান নাজিল করেছেন, যাতে করে নবীর ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্প্রদায় তা বুঝতে পারে। এটিই একমাত্র কারণ[6]।
গ্যালেন[7] ভুল করেছিলেন, যখন তিনি বলেছিলেন, “গ্রীক হলো শ্রেষ্ঠতম ভাষা, কারণ অন্যান্য ভাষা কুকুরের ঘেউ ঘেউ বা ব্যাঙ এর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক বলে মনে হয়।”
এটি একটি অশোভন অজ্ঞতা, যখন কেউ তার নিজের ভাষা বাদে অন্য কোনো অজানা ভাষা শুনে, তখন তার সে রকম অনুভূতিই হয়, যেমন গ্যালান বর্ণনা করেছেন।
মানুষ বলে থাকেন যেহেতু আল্লাহ তাঁর বাণী এই আরবী ভাষার মাধ্যমে পাঠিয়েছেন, সেহেতু এই ভাষা শ্রেষ্ঠ।
এটি কোনো অর্থই বহন করে না, কেননা আল্লাহ আমাদের বলেছেন, তিনি সবসময় রাসুলগণ পাঠিয়েছেন, যারা তাদের স্বজাতির ভাষায় কথা বলতেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَإِن مِّنْ أُمَّةٍ إِلَّا خلَا فِيهَا نَذِيرٌ
আমি আপনাকে সত্যধর্মসহ পাঠিয়েছি সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। এমন কোন সম্প্রদায় নেই যাতে সতর্ককারী আসেনি।
(সূরা ফাতির, ৩৫ : ২৪)
তিনি আরো বলেনঃ
وَإِنَّهُ لَفِي زُبُرِ الْأَوَّلِينَ
নিশ্চয় এর উল্লেখ আছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে।
(সূরা আস শু’আরা, ২৬ : ১৯৬)
এর অর্থ হলো আল্লাহর বাণী এবং ওহী সকল ভাষাতেই নাজিল হয়েছে। তিনি তৌরাত, ইঞ্জিল এবং যবুর পাঠিয়েছেন। তিনি মুসা আলাইহিসসালামের সাথে হিব্রু ভাষায় কথা বলেছেন। তিনি ইব্রাহীম আলাইহিসসালামের নিকট সিরিয়াক ভাষায় সহিফা পাঠিয়েছেন। সুতরাং, এই মাপকাঠিতে ভাষাসমূহ সব সমান।
জান্নাত এবং জাহান্নামের অধিবাসীদের ভাষা কি হবে, এই ব্যাপারে ওহী এবং ইজমা ব্যতীত আমাদের কোনো জ্ঞান থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এই দুই সূত্রে এ সংক্রান্ত কোনো জ্ঞানের অস্তিত্ব নেই। তবে তাঁরা নিঃসন্দেহে কোনো একটি ভাষায় কথা বলবেন, সুতরাং এ ক্ষেত্রে তিনটি, শুধুমাত্র তিনটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারেঃ তারা সেখানে বর্তমানে প্রচলিত আছে, এমন কোনো ভাষায় কথা বলবে, অথবা বর্তমানে অস্তিত্ব নেই এমন কোন ভাষায় কথা বলবে, অথবা তারা সকল ভাষার সমন্বয়ে কথা বলবে। তবে যে কোনো ঘটনায়, তাদের কথা-বার্তার যে চিত্র মহান আল্লাহ আমাদের সামনে উপস্থিত করেন, তাতে নিশ্চিতভাবেই দেখা যায় যে, তারা ( জান্নাত ও জাহান্নামের অধিবাসী) নিশ্চিতভাবেই বুদ্ধিমত্ত্বার সাথে একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে। হয় সে টি আরবীতে হবে যেমন ভাবে কুরানুল কারীমে বর্ণনা আছে, নতুবা অন্য কোনো ভাষায়। মহান আল্লাহই ভালো জানেন তা কেমন হবে।
কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, তাদের ভাষা হবে আরবী এবং প্রমাণ স্বরূপ আল্লাহর বাণী উদ্ধৃত করেছেনঃ
دَعْوَاهُمْ فِيهَا سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلاَمٌ وَآخِرُ دَعْوَاهُمْ أَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
সেখানে তাদের প্রার্থনা হল ‘পবিত্র তোমার সত্তা হে আল্লাহ’। আর শুভেচ্ছা হল সালাম আর তাদের প্রার্থনার সমাপ্তি হয়, ‘সমস্ত প্রশংসা বিশ্বপালক আল্লাহর জন্য’ বলে।
(সূরা ইউনুস, ১০ : ১০)
আমি তাদের পালটা যুক্তি দিয়ে বলি, তাহলে এটা তো জাহান্নামেরও ভাষা হবে, যেহেতু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সংবাদ দিয়েছেন, তারা কি কথপোকথন করবেঃ
وَبَرَزُواْ لِلّهِ جَمِيعًا فَقَالَ الضُّعَفَاء لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُواْ إِنَّا كُنَّا لَكُمْ تَبَعًا فَهَلْ أَنتُم مُّغْنُونَ عَنَّا مِنْ عَذَابِ اللّهِ مِن شَيْءٍ قَالُواْ لَوْ هَدَانَا اللّهُ لَهَدَيْنَاكُمْ سَوَاء عَلَيْنَآ أَجَزِعْنَا أَمْ صَبَرْنَا مَا لَنَا مِن مَّحِيصٍ
সবাই আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হবে এবং দুর্বলেরা বড়দেরকে বলবেঃ আমরা তো তোমাদের অনুসারী ছিলাম-অতএব, তোমরা আল্লাহর আযাব থেকে আমাদেরকে কিছুমাত্র রক্ষা করবে কি? তারা বলবেঃ যদি আল্লাহ আমাদেরকে সৎপথ দেখাতেন, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদের কে সৎপথ দেখাতাম। এখন তো আমাদের ধৈর্য্যচ্যুত হই কিংবা সবর করি-সবই আমাদের জন্যে সমান আমাদের রেহাই নেই।
(সূরা ইব্রাহীম, ১৪ : ২১)
তাদের আরো কথপোকথনঃ
وَنَادَى أَصْحَابُ النَّارِ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَنْ أَفِيضُواْ عَلَيْنَا مِنَ الْمَاء أَوْ مِمَّا رَزَقَكُمُ اللّهُ قَالُواْ إِنَّ اللّهَ حَرَّمَهُمَا عَلَى الْكَافِرِينَ
জাহান্নমীরা জান্নাতীদেরকে ডেকে বলবেঃ আমাদের উপর সামান্য পানি নিক্ষেপ কর অথবা আল্লাহ তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছেন, তা থেকেই কিছু দাও। তারা বলবেঃ আল্লাহ এই উভয় বস্তু কাফেরদের জন্যে নিষিদ্ধ করেছেন,
(সূরা আরাফ, ৭ : ৫০)
এরকম আরো কথাঃ
وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ
তারা আরও বলবেঃ যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থাকতাম না।
(সূরা আল মুলক, ৬৭ : ১০)
তখন তারা বলেন, হ্যাঁ তাই হবে।
তারপর আমি তাদের বলিঃ আপনাদের তাহলে এ কথার উপর স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ যে, আরবী মুসা আলাইহিসসালাম সহ অন্যান্য সকল নবীর ( আলাইহুমুসসালাম) ভাষা ছিলো, যেহেতু তাদের সকলের উক্তি কুরানুল কারীমে আরবীতে বর্ণনা করা হয়েছে।
যাই হোক আপনাদের রব আপনাদের কথা মিথ্যা প্রমাণ করেছেন, কারণ তিনি বলেছেনঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللّهُ مَن يَشَاء وَيَهْدِي مَن يَشَاء وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, পথঃভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন। তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।
(সূরা ইব্রাহীম, ১৪ : ৪)
এর অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহ আমাদের সামনে তারা সবাই যে সব ভাষায় কথা বলেছেন, তার ভাবার্থ আমরা যে ভাষা বুঝি, সে ভাষায় বর্ণনা করেছেন। যাতে করে তার অর্থ আমাদের সামনে পরিস্কার হয়। এবং এটাই সব।
বিভিন্ন ভাষায় বর্ণমালার ধ্বনিগুলো সবই এক, কারো অন্যের উপর কোনো প্রাধান্য নেই। এবং কোনো ভাষাতেই এমন কোনো অন্তর্নিহিত কদর্যতা বা সৌন্দর্য নেই, যা অন্য ভাষায় অনুপস্থিত। সকল ভাষার ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। সুতরাং, এই ধরনের যুক্তিহীন ও দুর্বল দাবি মিথ্যা। এবং সাফল্যের নির্ধারক একমাত্র আল্লাহ।
এটি সাধারণ্যে প্রচলিত এমনই এক ভ্রষ্টতা যে, কোনো কোনো ইহুদী মনে করত, হিব্রু ভাষা ব্যতীত অন্য যে কোনো ভাষায় মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা শপথ করা বৈধ। তারা দাবি করেছেন যে, যে সকল মালাইকাগণ[8] মানুষের আমলের বিবরণ আসমানে বহন করেন, তাঁরা হিব্রু ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষা বোঝেন না। আর তাই তারা তাদের কৃতকর্মের কোনো কিছু লিপিবদ্ধ করেন না। এটি স্পষ্ট বোকামী। যিনি অদৃশ্য জ্ঞানের জ্ঞানী এবং অন্তরেসমূহের খবর সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল, তিনি সকল ভাষা ও তাদের অর্থ জানেন। আল্লাহ ভিন্ন কোনো উপাস্য নেই। তিনিই শ্রেষ্ঠ সংরক্ষক এবং আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
বিঃ দ্রঃ আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, আরবি হলো কবরের ভাষা, হাশরের ভাষা এবং জান্নাত-জাহান্নামের ভাষা। অনেক আলেম এবং ওয়ায়েজীনগণ এই কথাটি বলে বেড়ান। এর মূল কারণ হলো একটি জাল হাদীস, যা নিম্নরূপঃ
“আমি আরবী ভাষী, কুরআন আরবী ভাষায় এবং জান্নাতীদের ভাষা আরবী। এ তিনটি কারণে তোমরা আরবদের মুহাব্বাত কর।”
(হাদীসটি হাকিম “আল-মুসতাদরাক” গ্রন্থে (৪/৮৭) এবং “মারিফাতু উলুমিল হাদীস” গ্রন্থে (পৃঃ ১৬১-১৬২), উকায়লী “আয-যুয়াফা” গ্রন্থে (৩২৭), তাবারানী “মুজামুল কাবীর” (৩/১২২/১) ও “আল-আওসাত” গ্রন্থে, তাম্মাম “আল-ফাওয়াইদ” গ্রন্থে (১/২২) এবং তার সূত্রে যিয়া আল-মাকদেসী “সিফাতুল জান্নাহ” গ্রন্থে (৩/৭৯/১), বাইহাকী “শুয়াবুল ঈমান” গ্রন্থে, ওয়াহেদী তার “আত-তাফসীর” গ্রন্থে (১/৮১) এবং ইবনু আসাকির ও আবূ বাকর আল-আম্বারী “ইযাহুল ওয়াকফ ওয়াল ইবতিদা” গ্রন্থে ‘আলী ইবনু আমর হানাফী সূত্রে ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াযীদ আল-আশয়ারী হতে, তিনি ইবনু যুরায়েজ হতে … বর্ণনা করেছেন।)
নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর যঈফ ও জাল হাদীস সঙ্কলন সিলসিলা আল যঈফাতে ( হাদীস নং-৬১) হাদীসটিকে জাল বলেছেন – অনুবাদক
[1] ভারতবর্ষ এর বাস্তব প্রমাণ, যেখানে শতাধিক ভাষা সহাবস্থান করে–অনুবাদক।
[2] আমাদের দেশে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে ভিন্ন সম্প্রদায় পানিকে জল বলে। প্রাকৃতিক কারণে নয়– অনুবাদক।
[3] আন্দালুসিয়ার ( বর্তমান স্পেন) এর একটি অঞ্চল—অনুবাদক।
[4] ইসলাম পূর্ব যুগে এবং ইসলামের প্রাথমিক উত্তর-পশ্চিন আফ্রিকার ( মরক্কো ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল) অধিবাসী। – অনুবাদক
[5] উত্তর-পশ্চিম স্পেনের একটি অঞ্চল। -অনুবাদক
[6] শুধুমাত্র কুরআনুল কারীম আরবী ভাষায় নাজিল হওয়ার কারণেই, আরবী ভাষা মুসলিমদের কাছে শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ করেছে। কুরানুল কারীম আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত শুধু একটি গ্রন্থই নয়, বরং একটি জীবন্ত মুজিজা, যা কিয়ামতের পূর্বে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টিকে থাকবে। – অনুবাদক
[7] অ্যালিয়াস গ্যালেনাস অথবা ক্লডিয়াস গ্যালেনাস ( ইংরেজীতে গ্যালেন) (জন্মঃ ১২৯ খৃস্টাব্দ) একজন গ্রীক দার্শনিক ও চিকিৎসক– অনুবাদক।
[8] ফেরেশতা। ফেরেশতা ফারসী শব্দ বিধায়, আমরা আরবী পরিভাষা মালাইকা ব্যবহার করেছি। -অনুবাদক