তাফসীর
“সূরা আল- ফাতিহা”
আয়াত নং ১.
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعالَمِينَ
যাবতীয় (সকল) প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক।
( الْحَمْدُ لِلَّهِ ) ‘আলহামদুলিল্লাহ’, আল্লাহর প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া আদায়ের সর্বোত্তম শব্দ হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ। কেননা রাসূল (সঃ) বলেছেন:-
الوضوءِ شطرُ الإيمانِ والحمدُ للهِ تملأ الميزانَ، وسبحان اللهِ والحمدُ للهِ تملآنِ أو تملأ ما بين السماءِ والأرضِ،
“অযূ ঈমানের অর্ধেক। আলহামদু লিল্লাহ (নেক আমলের) দাঁড়ি পাল্লাকে পূর্ণ করে দেয়। সুবাহানাল্লাহ্ ও আলহামদু লিল্লাহ একসাথে আকাশমন্ডলী ও যামীনের মধ্যবর্তী জায়গা (নেকী দিয়ে) ভর্তি করে দেয়”। -তিরমিজি, ৩৫১৭
( رَبِّ الْعالَمِينَ ) যিনি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক। ( رَبِّ ) প্রতি পালক,পরিচালক,লালন-পালনকারী, প্রভু , অভিভাবক, রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সংরক্ষণকারী। যেমন হাদিস শরীফে বাড়ির বা পরিবার প্রধানকে ‘রাব্বুল বাইত’ বলা হয়েছে। আর ( الْعالَمِينَ) হলো ( عالم ) শব্দের বহুবচন যার অর্থ বিশ্বজগৎ, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া যা কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে সব কিছু।
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য! এবং আল্লাহর প্রভুত্বের স্বরূপ:
কেন আমরা একমাত্র আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা আদায় করব? কিভাবে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে লালন পালন করছেন? রক্ষণাবেক্ষণ করছেন? তার প্রভুত্ব বা অভিভাবকত্ব কিভাবে আমাদের উপর ও গোটা সৃষ্টির উপর বিরাজমান? নিম্নে কয়েকটি নমুনার মাধ্যমে তুলে ধরা হলো:-
১. সমস্ত প্রশংসা বা কৃতিত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্য, কারণ গোটা সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, আসমান-জমীনের সবর্ত্র এবং সমস্ত মাখলুকের উপর একমাত্র তারই অভিবাবকত্ব। একমাত্র তিনিই প্রতি-পালন ও রক্ষণা-বেক্ষণ করেন। যেহেতু তিনি শুরুতে ছিলেন এবং শেষেও থাকেন। যা অন্য কোনো ব্যক্তি বা শক্তির প্রতিপালন ব্যবস্থার মধ্যে নেই। এইজন্য ফেরাউন যখন মূসা আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করেছিল বিশ্ব-জাহানের রব কে? তখন তিনি বলেছিলেন:-
قَالَ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّوۡقِنين
“মূসা বলল : ‘(যিনি) আসমান ও যমীন (বিশ্ব জগতের) ও এ দু’য়ের মাঝে যা কিছু আছে সব কিছুর প্রতিপালক (অভিভাবক, রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সংরক্ষণকারী) যদি তোমরা নিঃসন্দেহে বিশ্বাসী হও”। সুরা আশ-শোয়ারা২৪
তাই সমস্ত প্রশংসা বা কৃতিত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্য। আল্লাহ বলেন:-
وَ لَہُ الۡحَمۡدُ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ
“আর প্রশংসা তো একমাত্র তাঁরই আসমানসমূহে ও যমীনের সর্বত্র”। সূরা আর-রুম ১৮
فَلِلّٰہِ الۡحَمۡدُ رَبِّ السَّمٰوٰتِ وَ رَبِّ الۡاَرۡضِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
“অতএব আল্লাহরই জন্য সকল প্রশংসা, যিনি আসমানসমূহের রব, যমীনের রব ও সকল সৃষ্টির রব”। সূরা আল-জাসিয়া ৩৬
উদাহরণস্বরূপ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের লালন-পালনে আমাদের কোন ভূমিকা ছিল না। যেহেতু তখন আমাদের কোনো অস্তিত্ব ছিলনা। আবার আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে লালন-পালনেও শেষ পর্যন্ত আমাদের কোন ভূমিকা থাকেনা। যেহেতু আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। আমাদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। এজন্য মূসা আঃ ফেরাউনের নিকট রবের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে আরও বলেছিলেন:
قَالَ رَبُّکُمۡ وَ رَبُّ اٰبَآئِکُمُ الۡاَوَّلِیۡنَ
“মূসা বলল : ‘(তিনি) শুরু থেকেই তোমাদের প্রতিপালক ও পূর্ববর্তী তোমাদের বাপ-দাদাদেরও প্রতিপালক”। সুরা আশ-শুআ’রা ২৬
অনুরূপ ভাবে অন্য মাখলুকের ক্ষেত্রেও শুরু হতে শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের বা অন্য কারো কোন অভিবাবকত্ববা প্রভুত্ব নেই। যেহেতু শুরুতে তাদের অস্তিত্ব ছিলোনা এবং শেষ পর্যন্তও থাকবেনা। তাই শুরু হতে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় কৃতিত্ব ও প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর। তিনি বলেনঃ-
وَهُوَ اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ لَهُ الْحَمْدُ فِي الْأُولَىٰ وَالْآخِرَةِ ۖ وَلَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
“প্রথমে এবং শেষে সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর,যিনি ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ্ নেই, হুকুম তাঁরই, আর তোমাদেরকে তাঁর দিকেই ফিরিয়ে নেয়া হবে”। -সুরা কাসাস ৭০
২. আল্লাহ তায়ালা তিনি মানুষকে আসমান বৃষ্টি বর্ষণ এবং জমিন থেকে উদ্ভিদ,গাছ-পালা,ফল-ফসল ও খাদ্য শস্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে রিযিক দিয়ে লালন-পালন করতেছেন। তাই তিনি বলেছেন যাবতীয় প্রশংসা বা কৃতিত্ব তার জন্য।
وَ لَئِنۡ سَاَلۡتَہُمۡ مَّنۡ نَّزَّلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَحۡیَا بِہِ الۡاَرۡضَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَوۡتِہَا لَیَقُوۡلُنَّ اللّٰہُ ؕ قُلِ الۡحَمۡدُ لِلّٰہِ ؕ
“যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর- আকাশ হতে কে পানি বর্ষণ করে? যমীনকে তার মৃত্যুর পর আবার জীবিত করেন? (তাদের রিযিকের জন্য) তারা অবশ্য অবশ্যই বলবে- আল্লাহ। বল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য”। আন-কাবুত ৬৩।
৩. কৃতিত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্য তিনি মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ উপযোগী হেদায়েত তথা সঠিক রাস্তা দেখিয়েছেন। সেজন্য তার পক্ষ থেকে বার্তাবাহক প্রেরণ করেছেন, কিতাব তথা গাইডলাইন নাযিল করেছেন।
সুরা-আ’রাফের ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:-
الْحَمْد لِلَّهِ الَّذِي هَدَانَا لِهَذَاوَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلَا أَنْ هَدَانَا اللَّه
“যাবতীয় প্রশংসা সেই আল্লাহর। এই জন্য যে, তিনি আমাদেরকে হেদায়েত দিয়েছেন। তিনি যদি আমাদেরকে হেদায়েত না দিতেন, তাহলে আমরা হেদায়েত তথা সঠিক পথ প্রাপ্ত হতাম না”।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا
“সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি তাঁর বান্দা (বার্তাবাহকের) প্রতি কিতাব (মানুষের জন্য গাইড লাইন) নাযিল করেছেন, এবং যার মধ্যে কোন বক্রতা রাখেননি”। – আল- কাহাফ ০১।
৪. তার প্রতিপালন ব্যাবস্থায় তিনি হতাশা, দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি ও দুঃখ-বেদনায় নিমজ্জিত ব্যক্তির ভয়-ভীতি দুঃখ-দুর্দশা, অভাবির অভাব দূর করেন, পাপীর পাপ মোচন করেন। তাই সমস্ত প্রশংসা তার জন্য। তিনি বলেন;-
وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَذْهَبَ عَنَّا الْحَزَنَ ۖ إِنَّ رَبَّنَا لَغَفُورٌ شَكُورٌ
“এবং তারা বলবেঃ প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের দুঃখ দুর্দশা দূরীভূত করেছেন! নিশ্চয় আমাদের রব ক্ষমাশীল (পাপীদের), বড়ই মর্যাদানকারী”। -ফাতির ৩৪
৫. তিনি উত্তাল সমুদ্রে ভাসমান বিশাল জাহাজসমূহের আরোহী ও তাদের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। স্থলভাগে বিভিন্ন প্রকারের যানবাহনের আরোহী হেফাযতকারী। আকাশ পথের আরোহীদেরকেও তিনিই রক্ষা করেন। এই জন্য আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়ে বলেছেন:-
فَإِذَا اسْتَوَيْتَ أَنْتَ وَمَنْ مَعَكَ عَلَى الْفُلْكِ فَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ
“অতঃপর যখন তুমি ও তোমার সঙ্গীরা নৌযানে আরোহণ করবে তখন বলবে, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য”। -মুমিনুন ২৮।
৬. তিনি সন্তানহীন কে সন্তান দান করেন এবং অভাবগ্রস্থ ব্যক্তির অভাব দূর করেন, প্রার্থনা করীর প্রার্থনা কবুল করেন । তাই প্রশংসা একমাত্র তারই। যেভাবে ইব্রাহীম আঃ তার কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা করেছেন।
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ ۚ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ
“সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি বৃদ্ধ বয়সে আমাকে ঈসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক দো’আ শ্রবণকারী”। – ইব্রহীম ৩৯।
৭. আল্লাহ তার প্রভুত্বে তিনি মাজলুমের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন এবং অত্যাচারী ও জালিমদের কে ধ্বংস করেন। যেমনভাবে বদরের যুদ্ধে মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেছেন এবং কাফেরদের কে ধ্বংস করেছেন।
فَقُطِعَ دَابِرُ الۡقَوۡمِ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ؕ وَ الۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
“আর সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ জন্য, অতপর তিনি জালিমদের শিকড় উপড়ে ফেলে দিয়েছেন”। আনয়াম ৪৫
এছাড়াও পবিত্র কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য জায়গায় আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাতের বর্ণনা রয়েছে। যার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনিই একমাত্র প্রতিপালক, রক্ষণাবেক্ষণকারী, সংরক্ষণকারীও একমাত্র অভিভাবক । তাই তিনিই সকল প্রশংসার একমাত্র অধিকারী।
শিক্ষা ও প্রায়োগিক ক্ষেত্র:
‘আলহামদুলিল্লাহ’ প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সর্বোত্তম বাক্য ও জিকির। আমাদের প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে এবং প্রতিটা মুহূর্তের সাথে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অজস্র নেয়ামত জড়িত রয়েছে। আল্লাহ বলেন:-
وَ اِنۡ تَعُدُّوۡا نِعۡمَۃَ اللّٰہِ لَا تُحۡصُوۡہَا ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَغَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
“আর তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে ওর সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবেনা; আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমা পরায়ণ, পরম দয়ালু”। -নাহল ১৮
তাই খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, সুস্থতা লাভ, প্রশান্তি ও নিরাপত্তা,উপার্জন, অর্জন, সুখ্যাতি-সুনাম,দান-সদাকা সহ সমস্ত ইবাদত এবং প্রত্যেকটা কর্ম সম্পাদনের পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়া এবং ‘আলহামদুলিল্লাহ’ জিকিরের সাথে অভ্যস্ত হওয়া আবশ্যক।