দিলারা বেগম বিগত ১৯৯৬-৯৭ শিক্ষাবর্ষে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে চিকিৎসা শিক্ষা শুরু করেন। যদিও পরে এমবিবিএস পাশ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এই জালিয়াতিতে তিনি একাধিক ঠিকানা ও জন্মতারিখ ব্যবহার করেন। এ কাজে অধিদপ্তরের তৎকালীন কর্মচারীরা জিড়িত ছিলেন। অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিলারা বেগম বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০৩ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। ১৯৯৬-৯৭ শিক্ষাবর্ষে তার ভর্তিসংক্রান্ত কাগজপত্র নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, ভর্তি পরীক্ষায় তার নিবন্ধন নম্বর ছিল ডিএম-০৪২২। অর্থাৎ তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের আওতায় ভর্তি পরীক্ষার জন্য নিবন্ধিত হয়েছিলেন। তালিকা অনুযায়ী তার মেধাক্রম ছিল ৯৬৭। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে বাস্তবে তৎকালীন এ ধরনের কোনো মেধাক্রম খুঁজে পাওয়া যায়নি। অধিদপ্তরের তৎকালীন চিকিৎসা শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন দফতর থেকে দৈনিক অবজারভার পত্রিকায় ভর্তি পরীক্ষার মেধাক্রম প্রকাশ করা হয়। ১৯৯৭ সালের পহেলা মে তারিখে প্রকাশিত ফলাফলে কে কোন মেডিকেল কলেজে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছেন সেটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। তবে সেখানে এ ধরনের কোনো নম্বর নেই। যদিও অপেক্ষমাণ তালিকায় ৯৬ নম্বরে এই ক্রমটি খুঁজে পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিলারা বেগম ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রামের সেন্ট স্কলাস্টিকা গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও সরকারি মহসিন কলেজ থেকে ১৯৯৫ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৯৫ সালে এইচএসসি পাশ করলেও তিনি ১৯৯৬-৯৭ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। প্রাপ্ত সূত্রে দেখা গেছে, তার পিতার নাম সামশুল হুদা। শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় তিনি স্থায়ী ঠিকানার স্থানে উল্লেখ করেছেন গ্রাম : কাউয়াদি, পোস্ট : চরসিন্দুর, থানা : পালাশ, জেলা : নরসিংদী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবহৃত এই ঠিকানাটিও একজন চিকিৎসকের। যিনি ১৯৯৬-৯৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন এবং ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে এমবিবিএস পাশ করেন। বরিশাল মেডিকেলে ভর্তির সময় দিলারা বেগম তার জন্মতারিখ উল্লেখ করেছেন ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০। অন্য দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধকের অফিসের রেকর্ডে তার জন্মতারিখ ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৮। এমনকি শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ বরিশালের অধ্যক্ষ ডা. এএম সারোয়ার স্বাক্ষরিত এক নথিতে দেখা গেছে তার জন্মতারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার ভলিউম-১ থেকে দেখা গেছে তার নিবন্ধন নং-৮৮৮। এখানে তিনি ঠিকানা উল্লেখ করেছেন ৪২৭ ঘোষাল কোয়ার্টার, ঢাকা।
যুগান্তরের কাছে দিলারা বেগমের শেরেবাংলা মেডিকেলের একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টসহ এসএসসি, এইচএসসি সনদ, এমবিবিএসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ, বিএমডিসি সনদসহ বিভিন্ন দলিলপত্র রয়েছে। সেসব কাগজপত্রে এই জালিয়াতির বিষয়টির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় খোঁজ নিয়ে এই নামে ঢাকা শহরে কোনো ঠিকানার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এমনকি তিনি নরসিংদীর যে ঠিকানা ব্যবহার করেছেন সেখানের ভোটার তালিকা খুঁজে দিলারা বেগম ও পিতা সামশুল হুদা নামে কোনো ভোটার পাওয়া যায়নি। এমনকি সামশুল হুদা নামে কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি যার কন্যা চিকিৎসক।
অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তৎকালীন সময়ে পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন) ছিলেন অধ্যাপক ডা. শাহ মুনির হোসেন। ওই সময় তার দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মচারীর মাধ্যমে এই জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। সোলায়মান নামে এক অফিস সহকারী এ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। তার পদ অফিস সহকারী হলেও তিনি হিসাবরক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। তবে বর্তমানে তিনি এ পদে বা অধিদপ্তরে কর্মরত নেই। এ ধরনের অনেক অপকর্মের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। দিলারার পরিবারের সঙ্গে এই চক্রের সংযোগ স্থাপনকারী হিসাবে মনির আহমেদ নামে এক চশমার দোকানের কর্মচারীর নাম পাওয়া গেছে। তবে চট্টগ্রামের নূপুর মার্কেটের অপটিক্যাল ফ্যাশনের এই কর্মচারী যুগান্তরকে বলেন, তিনি দিলারার পরিবারের সবাইকে চেনেন। তবে এই ঘটনায় তিনি জড়িত নন।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় দিলারা বেগমের ভাই নাজমুল হুদার সঙ্গে। তবে তিনি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে কোনো কথা বলব না।’ ঘটনার সত্যতা জানতে দিলারা বেগমের যুক্তরাজ্যের নম্বরে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তবে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।