হাইওয়ে পুলিশের লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানার কনস্টেবল জাহাঙ্গীর আলম। তার ভাই আলমগীর হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার জিনোদপুর ইউনিয়নের যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি। যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত সেই ভাইয়ের সঙ্গে মিলে জাহাঙ্গীর নিজ হাতে চাপাতি দিয়ে হত্যা চেষ্টা করেন রাজীব হাসান তামিম নামের এক শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে! পুলিশ কনস্টেবল জাহাঙ্গীর ও তার ভাইয়ের চাপাতির কোপে রাজীবের দুই হাত পঙ্গু হয়ে গেছে।
এ ঘটনায় মামলা হলেও এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি অভিযুক্ত আলমগীর ও জাহাঙ্গীরকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৫২ নম্বর কেবিনের বেডে শুয়ে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছেন এই শিক্ষানবিশ আইনজীবী।
২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর নবীনগর থানার বাঙ্গুরা এলাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা স্বপ্না আক্তারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঐ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় চার নম্বর আসামি আলমগীর হোসেন। হত্যার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আলমগীরকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কারও করা হয়। স্বপ্না আক্তার হত্যায় আসামিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন জিনোদপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম। এর জের ধরে আলমগীর আওয়ামী লীগ নেতা রহিমকে হুমকি দিতে থাকেন। স্বপ্ন হত্যার বিচারের দাবিতে মাঠে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা রহিমের দ্বিতীয় সন্তান রাজীব হোসেন তামিমের ওপর নারকীয় এ হামলা চালায় কনস্টেবল জাহাঙ্গীর ও আলমগীর।
ঢাকায় বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স উত্তীর্ণ হওয়ার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালতে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। আদালতে স্বপ্না হত্যা মামলাটি নিয়ে আইনি লড়াইয়েও সহায়তা করেন রাজীব। এরই জের ধরে আলমগীর ও তার ভাই কনস্টেবল জাহাঙ্গীর সুযোগ খুঁজতে থাকেন রাজীবকে হত্যা করার। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মেরকুটা গ্রামে একটি চায়ের দোকানের সামনে রাজীবকে চাপাতি ও লোহার রড দিয়ে আঘাত করে। চাপাতির কোপে রাজীবের বাম হাতের কবজির হাড় কেটে যায়। শুধু মাংস লেগেছিল। ডান হাত লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় রাজীবকে চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
সেদিনের সেই হামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তার দুই চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। রাজীব বলেন, ‘চায়ের দোকানের সামনের চৌকিতে বসেছিলাম। হঠাত্ দেখি আলমগীর, তার ভাই জাহাঙ্গীরসহ ১০/১২ জন দোকানে ভিড় করল। ওরা আমাকে ধরে প্রথমে পেট বরাবর ২/৩ বার লাথি মারে। এরপর আলমগীর চাপাতি দিয়ে মাথায় কোপ দেয়। তখনো মাটিতে লুটিয়ে পড়িনি। জাহাঙ্গীর মাথায় কোপ দিতে গেলে আমি বাম হাত তুলে ঠেকাতে যাই। মুহূর্তের মধ্যে আমার হাতের হাড় কেটে যায়। মাংস নিয়ে হাতটি ঝুলতে থাকে। আমি চিত্কার করতে থাকি। তখন মোজাম্মেল ও জাকির চাপাতি দিয়ে মাথায় দুইবার কোপ দিলে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’
দুর্বৃত্তদের হামলায় তার দুইটি কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিত্সক ডা. জাহিদুর রহমান। তার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে। চিকিত্সকরা জানিয়েছেন, রাজীবের হাত রক্ষা করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করা প্রয়োজন। তা না হলে শরীরে গ্যাংগ্রিন হয়ে যেতে পারে। তখন পুরো হাত ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। কিন্তু তার হাতের ক্ষত সুস্থ না করা পর্যন্ত হাড়ের অপারেশন করা সম্ভব নয়। হাসপাতালের কেবিনের বেডে শুয়ে ছাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন রাজীব। দুই হাত সুস্থ হয়ে কবে তিনি আদালতে আইন চর্চায় যাবেন-সে চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
রাজীবের বাবা আব্দুর রহিম জানান, ৯ বছর আগে এক এসপির বাসায় চুরির অপরাধে কনস্টেবল জাহাঙ্গীরকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর মাঝে দুই বছর মালয়েশিয়া যান জাহাঙ্গীর। পরে সেখান থেকে এসে আদালতের মাধ্যমে পুলিশের চাকরি ফিরে পান তিনি। বর্তমানে হাইওয়ে পুলিশের চন্দ্রগঞ্জ থানায় কর্মরত। ঘটনার দিন কনস্টেবল জাহাঙ্গীর ছুটিতে ছিলেন। মামলার আসামি হওয়ার পর তার কর্মস্থলে আর ফিরেননি। জাহাঙ্গীরের ভাই আলমগীর হত্যা ও ইয়াবাসহ ১১ মামলার আসামি। আলমগীর জিনোদপুর ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। স্বপ্না হত্যা মামলায় যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পাশাপাশি গ্রেফতারও হন। পরে জামিনে বেরিয়ে এসে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এলাকায় জমি দখল, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
আব্দুর রহিম আরো বলেন, কয়েক মাস পর জিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। এ কারণে আলমগীর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরই জের ধরে পরিকল্পিতভাবে তার ছেলের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ঘটনায় তিনি জাহাঙ্গীর, আলমগীর, মোজাম্মেল, জাকিরসহ আট জনের নাম উল্লেখ করে নবীনগর থানায় হত্যা চেষ্টার মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য জাহাঙ্গীর অব্যাহতভাবে তাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।
নবীনগর থানার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই রনি বলেন, হত্যা চেষ্টার মামলায় দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযুক্ত আলমগীর ও জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে হাইওয়ে পুলিশে নোট পাঠানো হয়েছে। আপাতত তার বেতন বন্ধ রয়েছে।
ইত্তেফাক/এমএএম