বীমা কম্পানিগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে প্রিমিয়াম নিলেও মেয়াদ শেষে সঠিক সময় বীমা দাবি পরিশোধ করে না—এমন অভিযোগ অনেক দিনের। এই সমস্যা প্রতিটি জীবন বীমা কম্পানির বিরুদ্ধে থাকলেও পাঁচ-ছয়টি কম্পানির বিরুদ্ধে মেয়াদোত্তর বীমা দাবি নিষ্পত্তি না করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। সদ্য বিদায় নেওয়া বছরের জুন পর্যন্ত এসব কম্পানির অপরিশোধিত বীমা দাবির অর্থের পরিমাণ ২৬৬ কোটি ৯ লাখ টাকা, যা আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ছিল প্রায় ৪৬৫ কোটি ১২ লাখ টাকা।
গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচটি কম্পানির বিরুদ্ধে অন্তত ৩০ হাজার ২০০টি দাবি নিষ্পত্তি না করার অভিযোগ জমা পড়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে। এই কম্পানিরগুলো হলো গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি, বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি লিমিটেড, সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি লিমিটেড, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড ও পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি।
আইডিআরএ বলছে, নিষ্পত্তি না করা বীমা দাবির অর্থের পরিমাণ হয়তো আরো বেশি। কারণ কম্পানিগুলো যে হিসাব তাদের কাছে দেয়, সেটা সঠিক নয় বলেই ধারণা প্রতিষ্ঠানটির সূত্রগুলোর। একইভাবে অভিযোগের বাইরেও বীমা দাবি অপরিশোধিত থাকা গ্রাহকের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে।
এ ব্যাপারে এসব বেসরকারি জীবন বীমা কম্পানির মালিক ও পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বীমা দাবি পরিশোধ একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিদিন এই বীমা দাবি পরিশোধ করা হচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবতাটি কি আসলেই এ রকম? নওগাঁর সাপাহার উপজেলার মাদরাসা শিক্ষক রিনা পারভিন (৫৫) ২০০৮ সালে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সে ১০ বছর মেয়াদি একটি জীবন বীমা পলিসি খুলেছিলেন। তাঁর বীমার মেয়াদ শেষ হয়েছে দুই বছর আগে। কিন্তু তিনি এখনো অর্থ ফেরত পাননি।
পারভিন কালের কণ্ঠকে বলেন, এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি জানতে পেরেছেন, কম্পানি থেকেই টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। রিনা পারভিনের এজেন্ট ও নওগাঁ পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের সাপাহার শাখার প্রধান আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায় ৫০০ জন গ্রাহকের অর্থ এখনো অপরিশোধিত। কম্পানির ফান্ডে অর্থসংকটের কথা বলে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের অফিসাররা অনেক গ্রাহকের টাকা দিতে পারছেন না। ফলে পলিসির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও গ্রাহকরা অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না।’
এভাবেই দেশে ব্যবসা করা কয়েকটি জীবন বীমা কম্পানির গ্রাহকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে জানা যায়। ভবিষ্যতে আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বছরের পর বছর গ্রাহক টাকা (প্রিমিয়াম) জমা দিয়ে এলেও পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কম্পানি তাঁদের অর্থ ফেরত দিচ্ছে না।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ব্যবসায়ী সাদেক আহমেদ (৫৭) বলছিলেন, তিনি সান লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানিতে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি বীমা করেছিলেন। পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর পরেও কম্পানি তাঁকে অর্থ ফেরত দেয়নি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কম্পানির কাছে গিয়ে অভিযোগ করেছি। কিন্তু কম্পানি অর্থ ফেরত দেওয়ার সময় বারবার পেছাচ্ছে।’
দেশে বর্তমানে মোট ৭৯টি বীমা কম্পানি সেবা দিচ্ছে, যার মধ্যে ৩৩টি জীবন বীমা কম্পানি। আর ৪৬টি সাধারণ বীমা কম্পানি। জীবন বীমা কম্পানিগুলোর মধ্যে একটি সরকারি আর বাকিগুলো বেসরকারি মালিকানাধীন। অন্যদিকে সাধারণ বীমা কম্পানিগুলোর মধ্যেও একটি সরকারি, আর বাকিগুলো বেসরকারি।
বীমা আইন ৭২(১)-এ বলা হয়েছে, বীমার মেয়াদ শেষ হলে গ্রাহককে ৯০ দিনের মধ্যে তাঁর অর্থ ফেরত দিতে হবে। কিন্তু বীমা কম্পানিগুলোর অনিয়ম, দুর্নীতি, এজেন্টের মাধ্যমে নানা রকমের হয়রানির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা।
জীবন বীমা পাঁচ, দশ, বার, পনেরো, আঠারো ও বিশ বছর মেয়াদি হয়ে থাকে। দেশে বীমাসংক্রান্ত বেশির ভাগ কাজ হয় এজেন্টের মাধ্যমে। এতে করে গ্রাহক ও কম্পানির মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। তাই অনেক গ্রাহক এজেন্টের মাধ্যমে প্রতারণারও শিকার হচ্ছেন। অনেক সময় এজেন্ট চাকরি ছেড়ে চলে যান। সে ক্ষেত্রে বিপাকে পড়েন গ্রাহকরা।
ঢাকার ধামরাইয়ের জীবন নাহার (৬০) ১২ বছর আগে এলাকার বশিরুল্লাহ নামের এক এজেন্টের মাধ্যমে পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্সে ছেলের নামে একটি বীমা করেছিলেন। মাসে ৫০০ টাকার প্রিমিয়াম দিয়ে ১০ বছরে ৬০ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলেন। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর জীবন নাহার বীমা দাবি করলে কম্পানির এজেন্ট তাঁকে বোনাস হিসেবে ১৬ হাজার টাকা দেন। বাকি অর্থ এখনো অপরিশোধিত। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন সেই এজেন্টে পপুলার ইনস্যুরেন্সে চাকরি করেন না। আমাকে পুরো টাকা ফেরতও দেননি। টাকা ফেরত পাব কি না তা-ও জানি না।’
এজেন্ট বশিরুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্সে তিনি বর্তমানে কর্মরত নন। জীবন নাহার আর কত টাকা পাবেন সেই তথ্য তাঁর জানা নেই। পরে ধামরাইয়ের কালামপুর বাজারের পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্সের সার্ভিস সেলের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ বাকির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, জীবন নাহারের কাগজপত্র ঠিক থাকলে বাকি টাকা পরিশোধ করা হবে।
আইডিআরএর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, দেখা যায় বীমা কম্পানিগুলো শেয়ারবাজার অথবা নন-ব্যাংকিং খাতে অর্থ বিনিয়োগ করে। কিন্তু লগ্নিকৃত অর্থ ও মুনাফা সময়মতো উত্তোলন করে না। কিন্তু ইচ্ছা করলে অর্থ উত্তোলন করে গ্রাহককে ফেরত দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে কম্পানির মালিকদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তিনি আরো বলেন, কম্পানিগুলো জমি কিনে রাখে। কারণ জমির প্রকৃত দাম থেকে বাড়িয়ে দেখানো যায়। এভাবে কম্পানির কর্মকর্তারা অর্থ সরিয়ে ফেলার সুযোগ তৈরি করেন।
২০২০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত আইডিআরএর অভিযোগ সেলে জমা পড়া অভিযোগ পর্যালোচনা করে প্রায় দুই হাজার ৫০০টি বীমা দাবির অভিযোগ পাওয়া যায় বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি লিমিটেডের নামে। কম্পানিটি এক কোটি ৬৮ লাখ টাকা পরিশোধ করলেও অপরিশোধিত বীমা দাবির অর্থের পরিমাণ ২৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। কম্পানির মালিকের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণে গত বছর জুলাই মাসে কম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। দেশে বীমা কম্পানির বোর্ড ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার নজির এটাই প্রথম।
বায়রা ইনস্যুরেন্সের প্রশাসক হুমায়ূন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি বায়রার দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই তারল্য সংকট ছিল। বর্তমানেও সেই সমস্যা বিদ্যমান। জমিও বিক্রি করা যাচ্ছে না। কারণ জমিসংক্রান্ত মামলা এখনো চলছে।’ তিনি জানান, বর্তমানে ১১ হাজারেরও বেশি বীমা দাবি অপরিশোধিত। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর চার মাসে ৩২৩টি বীমা দাবির অর্থ পরিশোধ করেছেন, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ এক কোটি দুই লাখ ৫০ হাজার ৭৯৩ টাকার মতো।
আইডিআরএর একটি সূত্র জানিয়েছে, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইনসুরেন্স লিমিটেডের নামে ২০০-এর বেশি বীমা দাবি নিষ্পত্তি না করার অভিযোগ রয়েছে। কম্পানিটির ১৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকার বীমা দাবি অপরিশোধিত। গ্রাহকের আরো ৬১ কোটি টাকা এজেন্টের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় এজেন্ট প্রিমিয়ামের রসিদ জমা না দিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করেছে।
কম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইউসুফ আলী মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি দেড় মাস আগে কম্পানিতে নিয়োগ পেয়েছি। এখানে কাজ শুরুর পর থেকে সাত কোটি টাকা পরিশোধ করেছি। তবে আগামী বছর জুনের মধ্যে সকল অপরিশোধিত অর্থ গ্রাহককে ফেরত দেওয়া হবে।’
গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানির প্রায় পাঁচ হাজার গ্রাহক নানা সময় আইডিআরএর কাছে অভিযোগ করেছেন। কম্পানিটি মাত্র ২১ লাখ টাকার বীমা দাবি পরিশোধ করেছে। অপরিশোধিত অর্থের পরিমাণ ৬৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। তাই কম্পানিটির জমি বিক্রি করে গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আইডিআরএ।
আইডিআরএর বিভিন্ন সূত্র বলছে, ২০১৪-১৯ সাল পর্যন্ত কম্পানিটির প্রায় ৩০ হাজারের বেশি গ্রাহক তাঁদের অর্থ ফেরত পাননি।
গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান এ কে এম আজিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, গত বছর ২৪ হাজার ১৭৮টি বীমা পলিসির ৫০ কোটি ৪১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৯৩ টাকা অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এখনো প্রায় ছয় হাজার গ্রাহকের অপরিশোধিত বীমা দাবি রয়েছে, যার পরিমাণ ১৪ কোটি টাকারও বেশি। বীমা দাবি নিয়ে অভিযোগ বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতীতে তারল্য সংকট ছিল। তাই নানা রকমের সমস্যা হয়েছিল। আগামী বছরের মধ্যে সকল অর্থ পরিশোধ করা হবে।’
পদ্মা লাইফ ইনস্যুরেন্স অপরিশোধিত বীম দাবির অর্থের পরিমাণ ৮৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। পরিশোধিত ৩৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। কম্পানিটির বিরুদ্ধে আড়াই হাজারের মতো অভিযোগ পেয়েছে আইডিআরএ।
কম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোরশেদ আলম সিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বীমা পরিশোধ একটি চলমান প্রক্রিয়া। আগের অনেক বীমা অপরিশোধিত রয়েছে। কারণ আগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা ঠিকমতো ডাটা সংগ্রহ করতে পারেননি। কিন্তু এখন প্রতি মাসেই বীমা পরিশোধ করা হচ্ছে।’ তিনি জানান, এরই মধ্যে প্রায় ৫০ কোটি টাকার মতো বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমানে পাঁচ-ছয় হাজারের মতো গ্রাহকের ১৫ কোটির বেশি বীমা অপরিশোধিত। আগামী বছরের মধ্যেই সেগুলো পরিশোধ করা হবে।
হোমল্যান্ড লাইফ ইনসু্যুরেন্সের বেশ কিছু বীমা দাবি এখনো অপরিশোধিত। কম্পানির নামে বীমা দাবিকারির সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। আইডিআরএ সূত্র বলছে, কম্পানিটির বীমা দাবির অভিযোগ অনেক। পর্যাপ্ত তহবিল না থাকলেও কম্পানিটির অধীনে ১৪০ কাঠা জমি আছে। তারা জমি বিক্রি করে গ্রাহকের অর্থ পরিশোধ করার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে।
কম্পানিটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মঞ্জুর আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে কত অপরিশোধিত, সেই তথ্য আমার জানা নেই। আগামী মার্চে আরেকটি ডাটা করা হবে।’
আরেক কম্পানি সানলাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের নামে অভিযোগ এসেছে প্রায় ২০ হাজার। কম্পানিটি ১৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা পরিশোধ করলেও অপরিশোধিত আছে ৬৮ কোটি ১২ লাখ টাকা।
আইডিআরএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, কম্পানিটির উদ্যোক্তা ও পরিচালক রুবিনা হামিদ শুরু থেকেই কম্পানিটি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হননি। বিভিন্ন স্থানে জমি কিনলেও গ্রাহকের অর্থ অপরিশোধিত রয়েছে।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যে কয়েকটি অভিযোগ আসছে, সেগুলো নিয়ে একটা রিপোর্ট করা হবে। কারণ এই কম্পানিগুলোর গ্রাহক প্রতিনিয়ত বীমা দাবি নিয়ে অভিযোগ করছেন। আগামী বছরের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার নির্ধারিত একটা তারিখ দেওয়া আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কম্পানিগুলো অতিমাত্রায় নিয়ম ভঙ্গ করলে লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে। প্রয়োজন হলে বোর্ড ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে।’