তালেবান ও সরকারী বাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড লড়াইয়ের দরুন দক্ষিণ আফগানিস্তানের কয়েক হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে-বলেন সংশ্লিষ্টকর্মকর্তারা। শান্তি আলোচনা চলমান থাকা সত্ত্বেও দু’পক্ষের সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
তালেবান যোদ্ধারা সপ্তাহান্তে হেলমান্দ প্রদেশের লস্কর গাহ শহরে একাধিক হামলা চালিয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরকারী বাহিনীর সমর্থনে বিমান হামলা চালানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল।
বুধবার কমপক্ষে চারটি জেলায় লড়াই চলছিল, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী কয়েকবার তালেবান হামলা কে প্রতিহত করেছিল- আফগান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মোটরসাইকেল, টেক্সি, বাস বা স্থানীয় বিভিন্ন যানবাহনে চেপে যুদ্ধকবলিত এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এএফপি হেলমান্দ প্রদেশের শরণার্থীবিষয়ক পরিচালক মোহাম্মদ রামিনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে, অন্তত পাঁচ হাজার ১০০ পরিবার তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গেছে। সেখানে নারীও শিশুসহ অন্তত ৩০ হাজার মানুষ ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
“লস্করগাহে কিছু পরিবার এখনও রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে বাস করছে, তাদের আশ্রয় দেবার মতো তাঁবু আমাদের কাছে নেই।”
আফগানিস্তানের জাতিসংঘের সহায়তা মিশন, তালেবান যোদ্ধা ও সুরক্ষা বাহিনীকে “এলাকা ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের নিরাপদ পথ সহ বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য সমস্ত সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছে।”
স্থানীয় বাসিন্দা হেকমত উল্লাহ বলেন, একটি মর্টার শেলের আক্রমণে আমার এক প্রতিবেশীর ঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে দুই নারী নিহত হয়েছেন।’
আবদুল্লাহ আফগান নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমি আমার পরিবারের ১২ সদস্য নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছি। আমরা হাতের কাছে যা পেয়েছি তাই নিয়ে চলে এসেছি। কোনো খাবার বা বাড়তি কাপড় নিতে পারি নাই।’
নির্মম পরিস্থিতি
বুধবার একটি টুইটার পোস্টে মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ার বা এমএসএফ (মেডিকেল দাতব্য চিকিৎসক) জানিয়েছে যে, লস্করগাহের প্রধান ট্রমা হাসপাতালটিতে “আহতদের চিকিত্সার সক্ষমতা এখনও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। এমএসএফ-সমর্থিত বুস্ট প্রাদেশিক হাসপাতালটি ওভার-ফ্লো সুবিধা চালু রেখে কাজ করছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘন্টার মধ্যে অতিরিক্ত ২০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে এবং গর্ভবতী মহিলা ও শিশুসহ মোট রোগীর সংখ্যা ৪০ জনে উঠেছে।
পৃথকভাবে, জাতিসংঘের মানবিক বিষয়সমূহের সমন্বয় কার্যালয় থেকে বুধবার এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে যে, হেলমান্দের দুটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নাভা কমপ্রেসিয়েনস হেলথ ক্লিনিক এবং বোলান বেসিক হেলথ ক্লিনিক যুদ্ধের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।
“গেলো ১৪ ই অক্টোবর স্বাস্থ্য কর্মীদের জীবনের ঝুঁকির দরুন, নাদ-ই-আলী / মারজা, নহর-ই-সরজ, লস্করগাহ এবং নওয়াতে আরও সাতটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার পূর্বে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি কেবল মারাত্মক আঘাত প্রাপ্তদের যত্নের দিকে মনোনিবেশ করেছিল, যদিও সেগুলো স্বল্প ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ছিল।”– বিবৃতিটি থেকে প্রাপ্ত।
“স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি বন্ধ হওয়ায় এই অঞ্চলে ৩৮০০০ জনেরও বেশি লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যা তাদেরকে গুরুতর স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ থেকেও বঞ্চিত করে।”
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন পরিস্থিতিটিকে “অত্যন্ত উদ্বেগজনক” বলে বর্ণনা করেছে।
“চার দশকের দ্বন্দ্ব, আফগানিস্তানে শিশুদের জীবনে এক বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলেছে। তাদের পড়াশোনা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে এবং অনেকে বিস্ফোরক অস্ত্র বা স্কুল এবং হাসপাতালে হামলার শিকার হয়ে আহত বা নিহত হয়েছেন। এই বছর, শিশুরা সহিংসতায় সমস্ত বেসামরিক হতাহতের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ অংশ দখল করেছে এবং এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”- বুধবার এক বিবৃতিতে আফগানিস্তানের সেভ দা চিলড্রেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্রিস নায়মন্ডি এ কথা জানিয়েছেন।
মানসিক আঘাতগুলি আরও গভীর হতে পারে। হতাশা এবং উদ্বেগ অনেক বছর ধরে বাচ্চাদেরকে পীড়া দিতে পারে।
মার্কিন বিমান হামলা
কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে আন্তঃ-আফগান শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার এক মাসেরও বেশি সময় পরে এই প্রদেশে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার পরে এই আলোচনা সম্ভব হয়েছিল। তালেবানদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের বিনিময়ে আফগানিস্তানে অবস্থিত অবশিষ্ট সেনা, পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মার্কিনীরা।
সোমবার মার্কিন বাহিনী বলেছে, তালেবানদের আক্রমন মোকাবেলায় আফগান সুরক্ষা বাহিনীর সমর্থনে তারা হেলমান্দ প্রদেশে বেশ কয়েকটি বিমান হামলা চালিয়েছিল।
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল সনি লেগেট সোমবার জানান যে, হেলমান্দে সাম্প্রতিক তালেবান হামলা ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত মার্কিন-তালেবান চুক্তির সাথে “সামঞ্জস্যপূর্ণ” ছিল না। যা চলমান শান্তি আলোচনাকে ক্ষুন্ন করেছে।
তবে তিনি দাবি করেন যে, মার্কিন বিমান হামলাগুলি ফেব্রুয়ারির চুক্তিকে লঙ্ঘন করে নি।
হেলিকপ্টার সংঘর্ষের ঘটনা
এদিকে, হেলমান্দে দুটি হেলিকপ্টার সংঘর্ষে কমপক্ষে নয় জন নিহত হয়েছেন। যাদের সবাই আফগান সৈন্য ছিলেন।
দুটি সোভিয়েত আমলের এমআই-১৭ হেলিকপ্টার নাওয়া জেলায় যাত্রা করার সময় প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে বিধ্বস্ত হয়েছিল- বুধবার আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রাদেশিক গভর্নরের মুখপাত্র ওমর ঝওয়াক বলেছেন, হেলিকপ্টারগুলোতে আহত সৈন্যদের বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে, যোদ্ধারা বাগলান প্রদেশের গুজারগা-নূর জেলার নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পরে বন্দুকযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল এবং সেখানে কমপক্ষে ছয়জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত এবং দু’জন আহত হয়ছিল – প্রদেশের পুলিশ প্রধানের মুখপাত্র জাভেদ বাশারাত বলেন।
তিনি এই হামলার জন্য তালেবানকে দোষারোপ করেছেন এবং বলেছেন যে, তারা এখনও বর্ধমান বন্দুক যুদ্ধে শক্তি প্রেরণ করছে।
তালেবানরা তত্ক্ষণাত ব্যাগলানের যুদ্ধের বিষয়ে মন্তব্য করার অনুরোধের জবাব দেয়নি।
পশ্চিম হেরত প্রদেশে, রাস্তার পাশে পুতে রাখা বোমার আঘাতে কমপক্ষে পাঁচ জন ছোট শিশু মারা গিয়েছিল এবং ১০ জন বেসামরিক লোক আহত হয়েছিল- জিলানী ফরহাদ, প্রদেশের গভর্নরের মুখপাত্র বলেন।
তিনি বলেন যে, বেসামরিক কিছু লোক কুশ-কোহনা জেলার অন্য একটি গ্রামে একটি বিয়ের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় তাদের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটেছিল।
পূর্ব লঘ্মান প্রদেশে, একটি পুলিশ গাড়ীর সাথে সংযুক্ত চৌম্বকীয় বিস্ফোরক ডিভাইসের আঘাতে তিন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং আরও ১৪ জন আহত হয়েছে- প্রদেশের পুলিশ মুখপাত্র শফিউল্লাহ আফগানিয়ার বলেন।
হেরাট ও লগমন প্রদেশে বোমা হামলার জন্য তত্ক্ষণাত্ কেউ দায় স্বীকার করেনি।