ফিরোজ মান্না ॥ বিটিসিএলের নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। সারাদেশে এই চক্র এজেন্ট নিয়োগ করে কয়েক শ’ চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে নেয়। চক্রের হোতা এসএম আলমগীর হোসেন টাকা নিয়ে সিঙ্গাপুরে গেছে। তবে মূল এজেন্ট তানভীর মাহবুব ঢাকায় অফিস খুলে প্রতারণার ব্যবসা বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছে। বিটিসিএল প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করলেও পুলিশ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবরের এ ঘটনায় বিটিসিএল শের-ই-বাংলানগর থানায় একটি মামলা করেছে। মামলার একটি কপি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ডেপুটি কমিশনারের কাছেও দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতারক চক্রের কোন সদস্য এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি। পুলিশ এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে।
বিষয়টি নিয়ে বিটিসিএলের এমডি ড. রফিকুল মতিন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতারণার ঘটানাটি ঘটিয়েছিল ‘স্বনির্ভর সোনার বাংলা লিমিটেড’ নামের একটি ভুয়া কোম্পানি। ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর প্রতারক চক্র ‘দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। পরের দিন বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। আমরা ওই দিনই ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে একই পত্রিকায় আরেকটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছি। বিজ্ঞপ্তিতে সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। বিটিসিএলের ওয়েবসাইটেও ওই বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে সতর্কীকরণ নোটিস দেয়া হয়। এমনকি সব মিডিয়াতে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে প্রেস রিলিজ পাঠানো হয়েছিল। আমাদের দিক থেকে যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার যায় তা আমরা নিয়েছি। মামলাটি পুলিশ তদন্ত করছে বলে আমরা জেনেছি। কিন্ত তদন্তের কি অগ্রগতি এ বিষয়ে এখনও পুলিশ আমাদের কিছু জানায়নি। তবে আমরা এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। মূল প্রতারক দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছি। তবে চক্রের অন্য সদস্যরা দেশেই রয়েছে।
প্রতারণার শিকার মোঃ ইব্রাহীম হাওলাদার, আল মামুন, মোঃ আবুল কালাম, মোঃ সাঈদ হোসেন, রাজিব মিয়া, মোঃ আব্দুল আহাদ, রতন কুমার মণ্ডল, মোঃ মাহবুবুর রহমান, মোঃ সাব্বির হোসাইন ও আতিউর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তারা জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের বিটিসিএলে চাকরি দিয়ে বিভিন্ন জেলায় পোস্টিং দেয়া হয়। এই নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর দেন স্বনির্ভর সোনার বাংলা লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম আলমগীর হোসেন।
মোঃ ইব্রহীম হাওলাদার জনকণ্ঠকে বলেন, আমাকে বিটিসিএলে ‘কম্পিউটার অপারেটর’ হিসেবে চাকরি দেয়ার কথা ১২ লাখ টাকা নিয়েছে মোঃ তানভীর মাহবুব। এই তানভীর মাহবুব রাজধানীর প্রপার্র্টি রহিজ ৭২/১, মালিবাগে ৯ তলায় তার বাসা ও অফিস। তার গ্রামের বাড়ি পানিআড়া, থানা চান্দিনা, জেলা কুমিল্লা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি টাকা দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন আলমগীর সব টাকা নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেছে। যদিও তিনি মালিবাগে অফিস খুলে প্রতারণার ব্যবসা বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছেন। পুলিকে বার বার তার অফিসের ঠিকানা দেয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অন্যদিকে বিটিসিএলের করা মামলাটিরও কোন অগ্রগতি নেই। সারাদেশ থেকে আমার জানা মতে ৩ থেকে ৪ শ’ লোকের কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র।
মোঃ তানভীর মাহবুবের তিনটি ফোন নম্বর রয়েছে। প্রতিটি ফোনেই একাধিকবার ফোন করার পর তিনি একটি ফোন ধরেন। ফোন ধরার পর বিষয়টি বলার পরই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতে থাকেন। তিনি উচ্চৈস্বরে বলেন, আমাকে ফোন করার সাহস তুই কোথা থেকে পেলি। ‘আমাকে চেনোস-আমি কে। কত পুলিশ আমার অফিসে এসে বসে থাকে। তোকে তুলে নেয়ার ক্ষমতা রাখি। এর পর যদি ফোন করোস তাহলে তোর খবর আছে।’ এর পরও এই প্রতিবেদক তার সঙ্গে কথা চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন কয়েক শ’ লোকের কাছ থেকে টাকা নেয়ার কথা। তবে, এখন তার কাছে কোন টাকা নেই। সব টাকা নিয়ে গেছে স্বনির্ভর সোনার বাংলা লিমিটেডের এমডি আলমগীর। মাঝখান থেকে বিটিসিএল তার নামে দুটি মামলা করেছে।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) পরিচালক (জনসংযোগ ও প্রকাশনা) মীর মোহাম্মদ মোরশেদ বাদী হয়ে গত ২০ অক্টোবর ২০১৯ সালে শের-ই-বাংলা থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, গত ১৭ অক্টোবর ২০১৯ সালে ‘দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকার ৭ম পাতায় একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাপানো হয়েছে; যা বিটিসিএল কর্তৃক প্রদান করা হয়নি। এই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে বিটিসিএলের কোন সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞপ্তিতে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে ৭২৫ টি এবং অফিস সহকারী ৪০ টি পদে নিয়োগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে বিটিসিএলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাগণের কাছে এ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য জানতে প্রচুর কল আসছে এবং চাকরি প্রার্থীদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনটি প্রদান বিষয়ে অনুসন্ধানে উক্ত পত্রিকা থেকে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপন এজেন্সির একটি মানি রিসিট বিটিসিএলকে সরবরাহ করা হয়। যাতে দেখা যায়, আশা এ্যাডভার্টাইজিং (২/২, আরকে মিশন রোড, ঢাকা-১২১০ ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ০১৭৩৬৬১৮৭৭৭, ০১৬৩৩০৫৮৮৮ এবং ই-মেইল এড্রেস ধংযধধফ২০১০@মসধরষ.পড়স উল্লেখ রয়েছে) হতে পত্রিকাটিতে বিজ্ঞাপন প্রদান করা হয়েছে। অবৈধভাবে বিজ্ঞাপন প্রকাশের বিষয়ে শের-ই-বাংলানগর থানায় একটি জিডি-১১১৩-তারিখ ১৭/১০/১৯, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কারণে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং জনসাধারণ তথা চাকরিপ্রার্থীদের মাঝে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য ১৮ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে ‘দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকার প্রথম পাতায় বিটিসিএল একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে। বিটিসিএলের অনলাইনেও ভুয়া বিজ্ঞপ্তিটি ৫ টি ওয়েবসাইটে প্রচার করা হয়েছে। এমতাবস্থায় বিষয়টি তদন্ত করে ভুয়া বিজ্ঞাপনদাতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এদিকে ভুয়া বিজ্ঞপ্তি প্রচারকারী ও তার সহযোগী চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নিলেও কারো কোন টাকা ফেরত দেয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে চাকরি প্রর্থী যারা টাকা দিয়েছেন, তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বিটিসিএল শুধু একটি জিডি করেই বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করেছেন। ওই জিডি ও সাইবার ক্রাইমের ডেপুটি কমিশনারকে জানিয়েই শেষ করেছেন। আমরা প্রতারক চক্রের সব ঠিকানা, মোবাইল নম্বর বিটিসিএলকে দিলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে এ বিষয়ে পুলিশও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিটিসিএল যদি আন্তরিক হতো পুলিশ এতদিন প্রতারক চক্রের অনেক সদস্যকে আটক করতে পারত।