বিআইডব্লিউটিএ’র (অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ) কতিপয় সিবিএ নেতা রীতিমতো আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। সিবিএ নেতাদের কেউ কেউ নাম লিখিয়েছেন জাহাজ ব্যবসায়।
এছাড়া শিপিং লাইন, ডকইয়ার্ড, ঘাট ইজারা এবং একচেটিয়া বালু ব্যবসা করছে অসাধু নেতাদের একটি চক্র। সিবিএ নেতাদের অনেকে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে নিজের একাধিক আত্মীয়স্বজনকে বিআইডব্লিউটিএতে গণহারে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।
কেউ কেউ নেতাগিরি হারানোর ভয়ে পদোন্নতি নিতেও রাজি নন। সিবিএ চক্রের সঙ্গে হাত মিলিছেন অফিসার সমিতির নেতারাও। এমনকি বিআইডব্লিউটিএ’র বেশ কয়েকজন বিভাগীয় প্রধান সিবিএ’র দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন।
চাকরি বাণিজ্য : সিবিএ নেতা সারোয়ার হোসাইন আগে শুল্ক আদায়কারী ছিলেন। এখন তার পদবি সহকারী। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও বিআইডব্লিউটিএ’র অঘোষিত হর্তাকর্তা তিনি।
নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে ঘাটের ইজারা-সবকিছুতেই নাম আছে সারোয়ারের। স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেকের মতোই বিআইডব্লিউটিএ অনেকটা তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
স্ত্রী, শ্যালক, শ্যালিকাসহ অন্তত ২৫ জন নিকটাত্মীয়কে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন যথাযথ যোগ্যতা না থাকার পরও চাকরি পেয়েছেন।
বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ’র বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন তার স্ত্রী কামরুন নাহার (পদবি ট্রেসার), স্ত্রীর বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম (শুল্ক আদায়কারী) চাচাতো শ্যালক আহসান আল কাইয়ুম (শুল্ক আদায়কারী) শ্যালকের স্ত্রী রুমেনা আক্তার (হিসাব বিভাগে কর্মরত), চাচাতো শ্যালক সুরুজ্জামান (শুল্ক আদায়কারী), মামা ইউসুফ মিয়া (পদবি পাইলট), মামাতো ভাই আনিসুর রহমান (শুল্ক প্রহরী), মামাতো ভাইয়ের স্ত্রী নাজমা বেগম চাকরি করেন ড্রেজিং বিভাগে, চাচাতো ভাই নজরুল ইসলাম (গাড়িচালক), ফুপাতো ভাই আলী আব্বাস (স্টেনো টাইপিস্ট), নৌ নিট্রা (নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) বিভাগে কর্মরত আরেক চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ। এছাড়া খালাতো ভাই আশরাফ হিসাব বিভাগে এবং আবদুল জলিল নামের এক খালু বন্দর বিভাগে কর্মরত আছেন।
নেতাদের অঢেল সম্পদ : অনির্বাচিত সিবিএ নেতা সারোয়ার, আবুল হোসেন এবং রফিকুল ইসলামের বিত্তবৈভব যেন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। জাহাজ ব্যবসা, শিপিং লাইন, অয়েল ট্যাঙ্কার, ডকইয়ার্ড, কোটি টাকার ফ্ল্যাট, একাধিক প্লট, দামি গাড়ি-কী নেই তাদের। অঢেল সম্পদ গোপন করতে কেউ কেউ প্রবাসী আত্মীয়স্বজনের নামে সম্পদ গড়েছেন।
সিবিএ নেতা সারোয়ারের বেশির ভাগ সম্পদ আছে লন্ডন প্রবাসী শ্যালিকা নুরুন্নাহার পারভীনের নামে। প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের এমভি মর্নিং ভয়েজ-১ (এম-০১-১৫৯৩)-এর রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে তার নামে। কোম্পানির নাম লিজেন্ড-১০ শিপিং লাইন্স (প্রা.) লি।
রাজধানীর পুরানা পল্টনের ৫৫/বি নোয়াখালী টাওয়ারের দশম তলায় সুবিশাল অফিস আছে সারোয়ারের। এছাড়া তিনটি বালুবাহী জাহাজ ও তিনটি অয়েল ট্যাঙ্কার এবং নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের বিপরীতে খন্দকার শিপইয়ার্ডেও তার রয়েছে অংশীদারিত্ব।
সূত্র জানায়, বিআইডব্লিউটিএ’র দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ সারোয়ারের ব্যবসায়িক অংশীদার। এর মধ্যে বরখাস্ত নিম্নমান সহকারী এমদাদ হোসেন অন্যতম। সারোয়ার-এমদাদের যৌথ বিনিয়োগে চলাচল করছে এমভি সুমনা হক-১ (এম-০১-২০৪৫) নামের জাহাজ।
সারোয়ারের নেতৃত্বে দুর্নীতিবাজ চক্র ডজন রোজ নামের আরেকটি কোম্পানি খুলে শিপিং লাইনের ব্যবসায় নেমেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ভারত বাংলাদেশ রুটে সারোয়ার গংয়ের মালিকানাধীন পণ্যবাহী একাধিক কোস্টার বা কার্গো ভেসেল চলাচল করছে।
খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকার ২২ নম্বর রোডে ৮৪ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন সারোয়ার।
আরেক সিবিএ নেতা রফিকুল ইসলাম কোটিপতি বনেছেন বহু আগেই। বিআইডব্লিউটিএ’র ঘাট ইজারা থেকে শুরু করে নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত রফিক। নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পোস্টিং হলেও তিনি কর্মস্থলে যান না।
সিবিএ নেতাগিরি করতে পড়ে থাকেন মতিঝিলে। রফিক কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর এলাকায় ১ কোটি ৪০ লাখ টাকায় বাড়ি কিনেছেন। এছাড়া অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র বিশাল জায়গা লিজও নিয়েছেন।
সেখানে স্ত্রী সাহিদা এবং ছেলে ইব্রাহিমের নামে দুটি ডকইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। আরেক ছেলে ওমর ফারুককে বিআইডব্লিউটিএ’র মার্কম্যান পদে চাকরি পাইয়ে দেন। চাকরি মার্কম্যানের হলেও তিনি ডিউটি করেন রাজস্ব শাখায়।
সিবিএ নেতা আবুল হোসেনের বিরুদ্ধেও অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তারও একাধিক নিকটাত্মীয় বিআইডব্লিউটিএ’র বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন। আবুলের ভাগিনা আলামিন চাকরি করেন লস্কর পদে।
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ-নির্দেশের ধার ধারেন না তিনি। আবুলের ভাই মেহেদী হাসানও বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মচারী। তবে মেহেদীর চাকরি হয় বড় ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে। বয়স জালিয়াতি করে মার্কম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে।
আবুলের মেয়ের জামাই বিআইডব্লিউটিএ’র তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএ’র এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আবুল হোসেন নিম্নমান সহকারী হিসেবে চাকরিতে ঢোকেন। পরে সহকারী হিসেবে তার পদোন্নতি হয়। তবে সিবিএ’র নেতাগিরি করার জন্য তিনি আর পদোন্নতি নিতে রাজি নন।
এমনকি নিজের পদোন্নতি আটকে রাখতে নিজেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এসিআর বুকে নেতিবাচক মন্তব্য লিখিয়ে নেন। আবুলের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায়। নিজের এলাকায় তিনি আদম ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।
দুর্নীতির সিন্ডিকেট : সিবিএ নেতাদের মধ্যে সারোয়ার, আবুল হোসেন, রফিকুল ইসলাম, আক্তার হোসেন এবং পান্না বিশ্বাস মিলে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এ চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন অফিসার সমিতির নেতারাও।
এমনকি বিআইডব্লিউটিএ’র বেশ কয়েকজন বিভাগীয় প্রধান সিবিএ’র দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করেন।
অভিযোগ আছে, কর্মকর্তা আওয়াল, রফিকুল ইসলাম, ওয়াকিল নেওয়াজ, জাফর হাওলাদার, আবদুল মতিন, আবু তাহের, শাহজাহান, নিম্নমান সহকারী এমদাদুল হক (সাময়িক বরখাস্ত) এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম ও সফিকুল হক অসাধু সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।
সূত্র বলছে, সিবিএ নেতাদের অনেকে ঘাট ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। অভিনব কারসাজির মাধ্যমে বেনামে ঘাটের ইজারা নেন তারা। তাদের ইচ্ছের বাইরে কেউ ইজারা পান না।
কালেভদ্রে কেউ সর্বনিম্ন দরদাতা হলে লোক দেখানো কমিটি গঠন করে পুনঃদরপত্র ডাকা হয়। শুধু ঘাট ইজারা নয়, দেশের বিভিন্ন নদীবন্দর থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করেন বিআইডব্লিউটিএ’র দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
বিশেষ করে ঢাকা বন্দর (সদরঘাট), নারায়ণগঞ্জ, আরিচা, বরিশাল, চাঁদপুর (কেরিনা ফেরিঘাট) এবং নরসিংদী বন্দর থেকে মাসোহারা আদায়ের ব্যাপারটি অনেকটা ওপেন সিক্রেট।
সিবিএ নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একচেটিয়া ড্রেজার এবং বালু ব্যবসা করছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। সাভার এবং হেমায়েতপুর এলাকায় বিআইডব্লিউটিএ’র স্থাপনা ব্যবহার করে দুর্নীতিবাজদের জমজমাট বালু ব্যবসা চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
সূত্র বলছে, বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তাদের দালাল হিসেবে পরিচিত কাজী ইকবাল এখন অঢেল টাকার মালিক। প্রভাবশালী এক বিএনপি নেতার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি।
বিআইডব্লিউটিএ’র দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অনেকে কাজী ইকবালের মাধ্যমে ঘুষের টাকা লেনদেন করেন।
আবার অনেকে তার মাধ্যমে অবৈধ টাকা বিদেশে পাচারের কাজটিও সেরে নেন। এছাড়া দীপু নামের ঠিকাদার বিআইডব্লিউটিএ’র ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। তিনি সাবেক এক মন্ত্রীর শ্যালক হিসেবে পরিচিত।
এছাড়া মাহবুব নামের সাবেক একজন পুলিশ কর্মকর্তা জাহাজ ব্যবসায় নাম লেখানোর পর বিআইডব্লিউটিএতে প্রভাবশালী বনে গেছেন।
তিনি কথায় কথায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার সখ্য থাকার ফিরিস্তি দেন। বিভিন্ন থানার ওসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা প্রচার করেন নিজেই।
বর্তমানে ঢাকা-চাঁদপুর রুটে তার ৪টি যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল করছে। এছাড়া তেলবাহী বিশালাকার ট্যাঙ্কার রয়েছে বেশ কয়েকটি।
সূত্র বলছে, বিআইডব্লিউটিএ’র অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে যাচ্ছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে অসৎ কর্মকর্তাদের একটি তালিকা দুদকে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীকে কোটি টাকার গাড়ি উপঢৌকন দেয়ার ঘটনায় সিরাজ নামের এক কর্মকর্তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এছাড়া চিহ্নিত বেশ কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিবিএ নেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, দুদক থেকে আমার সম্পদের অনুসন্ধান করা হচ্ছে। আমি দুদকে সম্পদবিবরণী জমা দিয়েছি। আপনারাও তদন্ত করুন। আসলে আমার তেমন কিছুই নেই। ভাড়া বাসায় থাকি।
আমার সব সম্পত্তি দেড় কোটি টাকারও হবে না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার দুই ছেলে বিআইডব্লিউটিএতে চাকরি করে এটা সত্য। আরেক নেতা সারোয়ার হোসাইনের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
বিআইডব্লিউটিএ অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল নম্বরে বক্তব্য চেয়ে বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি। অপর নেতা আবুল হোসেনের মোবাইলে রিং হলেও ফোন ধরেননি। খুদে বার্তার উত্তরও দেননি তিনি।