নাটোরের লালপুর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে প্রায় ২০ বছর ধরে গাছ-গাছড়া দিয়ে হাড়ভাঙা চিকিৎসার রমরমা ব্যবসা প্রশাসনের এক অভিযানে তছনছ হয়ে গেছে। গা ঢাকা দিয়েছে শতাধিক কবিরাজ, বাড়ি বাড়ি থাকা সাইন বোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে, চিকিৎসা নিতে আসা হাড়ভাঙা রোগীরাও যে যার মত গ্রাম ছেড়েছে।
মিনি হাসপাতাল খ্যাত রোগীর থাকার ঘরগুলো এখন ফাকা পড়ে আছে। নতুন করে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার দুপুরে নাটোরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউর রহমান, নাটোর পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা ও নাটোরের সিভিল সার্জন মিজানুর রহমান অভিযানকালে উপস্থিত ছিলেন। দুপুরে ইসলামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে, দু’একজন রোগী তখনো বাড়ি ফিরছে। বেলা দু’টোর দিকে আবুল কবিরাজের বাড়ির সামনে একটি মাইক্রোতে পা ভাঙ্গা এক রোগীকে আসতে দেখা গেলো। রোগীর স্বজন বাকি বিল্লাহ জানালেন তারা ফরিদপুর থেকে এসেছেন। এখানে হাড়ভাঙা ভালো হয় বলে তিনি শুনেছেন। পুলিশ সেই মাইক্রোবাসটি ফিরিয়ে দেয়।
পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা জানান, তিনি সম্প্রতি জানতে পারেন ইসলামপুর গ্রামে হাড়ভাঙা চিকিৎসার নামে প্রতারণার মাধ্যমে অপচিকিৎসা চলছে। এই অপচিকিৎসা যাতে চলতে না পারে সেজন্য প্রতিটি কবিরাজ বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে। তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। এ অবস্থা যাতে চলতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাটোরর সিভিল সার্জন মিজানুর রহমান জানান, ইসলামপুরের কবিরাজি চিকিৎসার নামে যাতে আর কেউ অপচিকৎসা করে মানুষের ক্ষতি না করতে পারে সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গ্রামের পরিচিতি পাল্টে দিয়েছে হাড়ভাঙার কবিরাজরা। গ্রামের আদি নাম গোবরগাড়ী স্বাধীনতার পর গ্রামবাসী সে নাম বদলে ইসলামপুর করেছেন। কিন্তু বর্তমানে সে নামও এখন পরিচিতি পাচ্ছে কবিরাজের গ্রাম হিসেবে। গ্রামে হাড় জোড় ভাঙা চিকিৎসার কবিরাজের সংখ্যা শতাধিক। দিন মজুর, ভ্যান চালকসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন এখন হাড়ভাঙা চিকিৎসার কবিরাজ।
গ্রামের প্রবীন হাড়ভাঙা চিকিৎসার কবিরাজ মোহসিন আলী জানালেন গ্রামে এখন হাড় জোড় ভাঙা চিকিৎসার কবিরাজের সংখ্যা শতাধিক। যাদের অনেকেরই কোন অভিজ্ঞতা নেই। হাড়ভাঙা চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত গাছ চিনে নিয়েই কবিরাজ বনে গেছেন তারা। এই ধরনের কবিরাজের কারণেই বদনাম হচ্ছে। অনেক কবিরাজ মারও খাচ্ছেন। তিনি ২৫ বছর ধরে এ পেশায় রয়েছেন প্রশাসনের অনেক লোকও তার চিকিৎসায় ভালো হয়েছেন বলে জানান তিনি। তবে তিনি কারো নাম বলতে চাননি।
তাকে সহযোগীতা করেন তার ছেলে সেলিম রেজা, তিনি বলেন, ‘ শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সেনা সদস্য, পুলিশ সহ নানা পেশার প্রায় লক্ষাধিক হাড়ভাঙা রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছি। সারাদেশে আমাদের রোগী রয়েছে যারা ভালো হয়েছেন।’
তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, হাড়জোড় বিশেষজ্ঞ ডা. বিকে দাম, ডা. দেবাশীষ স্যারের কাছে যদি আমার মত কেই থাকতো তবে কোন রোগীকেই ফিরে আসতে হতো না। হাড় ভাঙার চিকিৎসার ক্ষেত্রে সেটিংটাই আসল। তিনি হাড়ভাঙা চিকিৎসায় ব্যবহৃত কয়েক প্রকার গাছ বাড়ির চারপাশ ঘুরিয়ে দেখান।
নাটোর সদর হাসপাতালের বিশিষ্ট অর্থপেডিক সার্জন ড. তৈমুর রহমান বলেন, হাড়ভাঙার ক্ষেত্রে কবিরাজী চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই। মানুষকে হিপনোটাইজ করে মান্ধাতার আমল থেকে এক শ্রেণির লোক এসব কাজ করে থাকে। গাছ গাছড়া বিষয়টি আসলে কিছুই না। ভাঙা হাড় মুখোমুখি করে রাখলে এমনিতেই জোড়া লেগে যায়।’
তিনি আরো বলেন, কবিরাজী চিকিৎসার কারণে অনেকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। কিছুদিন আগে তার কছে ১৮/১৯ বছরের এক মেয়ে এসেছিল তার কুনই ভেঙে যাওয়ায় কবিরাজি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। হাতে পচন ধরায় শেষ পর্যন্ত তার হাতই কেটে ফেলতে হয়েছে। এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল