তাফসীর “সূরা আল-ফাতিহা”
আয়াত নং০৪ ( اِیَّاکَ نَعۡبُدُ وَ اِیَّاکَ نَسۡتَعِیۡنُ )
আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
( اِیَّاکَ نَعۡبُدُ ُ ) অর্থ্যাৎ: “আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি, তুমি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করিনা”।
এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর একত্ববাদ তথা তাওহীদের উপর, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর দাবির ওপর আমরা প্রতিষ্ঠিত আছি এই ঘোষণা প্রদান করি। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এবাদত করি কারণ তিনি আমাদের স্রষ্টা। আমরা তার গোলাম বা দাস। তাই তিনিই একমাত্র ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। তার ইবাদতের সাথে কাউকে শরিক করা যাবেনা। সকল আনুগত্য, উপাসনা, বন্দেগী ও দাসত্ব একমাত্র তার জন্য।
ইবাদতের পরিচয়:
العبادة اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأفعال الظاهرة والباطنة
“আল্লাহ যা পছন্দ করেন ও ভালবাসেন এমন প্রত্যেকটি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজের নাম হচ্ছে ইবাদাত”। -তাফসির আস-সা’দী.
ইবাদত একমাত্র আল্লাহর:
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকেএকমাত্র তার ইবাদতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন;-
وَ مَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَ الْاِنْسَ اِلَّا لِیَعْبُدُوْنِ
“আমি জিন ও মানুষকে শুধু এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার দাসত্ব করবে”। আয-যারিয়াত:৫৬,
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّكُمُ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ وَ الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ
“হে মানব জাতি! ইবাদাত করো তোমাদের রবের, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তী সবার সৃষ্টিকর্তা”। আল-বাক্বারাহ:২১
আর ইবাদত করতে হবে সকল প্রকার শির্ক থেকে পবিত্র থাকার মাধ্যমে।
وَ اعْبُدُوا اللّٰهَ وَ لَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَیْــٴًـا
“আর তোমরা সবাই আল্লাহর ইবাদত করো। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না”। আন-নিসা:৩৬,
وَ لَقَدْ بَعَثْنَا فِیْ كُلِّ اُمَّةٍ رَّسُوْلًا اَنِ اعْبُدُوا اللّٰهَ وَ اجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَۚ
“প্রত্যেক জাতির মধ্যে আমি রসূল পাঠিয়েছি যেন তোমরা একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করো এবং তাগূতের বন্দেগী পরিহার করো।”-আন্-নহল:৩৬,
ইবাদত কবুল হওয়ার শর্তঃ-
কোন কিছু আল্লাহর দরবারে ইবাদত হিসেবে কবুল হওয়ার জন্য দুটি শর্ত অবশ্যই থাকবে।
প্রথমতঃ ‘ইখলাস’ তথা যে ইবাদতে পরিপূর্ণ ভালোবাসা, বিনয়, ভীতি ও নিবেদন একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হতে হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:-
وَ مَاۤ اُمِرُوْۤا اِلَّا لِیَعْبُدُوا اللّٰهَ مُخْلِصِیْنَ لَهُ الدِّیْنَ حُنَفَآءَ
“ আর তাদেরকে হুকুম দেয়া হয়েছে যে, তারা নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদাত করবে”। -আল-বাইয়েনাহ:৫
দ্বিতীয়তঃ রাসূল (সঃ) এর প্রদর্শিত পদ্ধতি। আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন, পছন্দ করেন এমন প্রত্যেকটি কথা ও কাজ রাসূল (সঃ) দেখানো পদ্ধতির ভিত্তিতে সম্পাদন করতে হবে। অন্যথায় তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:-
قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللّٰهَ فَاتَّبِعُوْنِیْ یُحْبِبْكُمُ اللّٰهُ وَ یَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْؕ وَ اللّٰهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ
“হে নবী! আপনি বলুন; “যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে(আল্লাহর হুকুম পালন করার ক্ষেত্রে) আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।”-আলে-ইমরান:৩১
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিতঃ: রাসুল (সঃ) বলেন:-
«مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ علَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ»
“যে ব্যক্তি এমন (ইবাদত) কর্ম করল, যার সম্পর্কে আমাদের কোন প্রকার নির্দেশ নেই—তা প্রত্যাখ্যাত”। -মুসলিম
সুতরাং কোন কিছু আল্লাহর দরবারে ইবাদত হিসেবে কবুল হওয়ার জন্য দুটি শর্ত অবশ্যই থাকতে হবে।
(وَ اِیَّاکَ نَسۡتَعِیۡنُ ) “কেবলমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি”। অর্থ্যাৎ: অন্য কারো কাছে সাহায্যের জন্য ধরনা দেই না।
( الاستعانة ) তথা সাহায্য প্রার্থনা দ্বারা সব ধরনের কল্যাণ লাভ এবং সমস্ত অমঙ্গল হতে রক্ষা পেতে আল্লাহর উপর নির্ভর করা। ঈমানদারের ইবাদত ও সাহায্য প্রার্থনার সম্পর্ক একমাত্র আল্লাহর সাথে থাকবে। কারণ তিনি হচ্ছেন বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক। সবার অভাব এবং প্রয়োজন একমাত্র তিনি পূরণ করেন। সবাই তার উপর নির্ভরশীল। সেজন্য আল্লাহ তায়ালা বলেন-
اَمَّنۡ یُّجِیۡبُ الۡمُضۡطَرَّ اِذَا دَعَاہُ وَ یَکۡشِفُ السُّوۡٓءَ وَ یَجۡعَلُکُمۡ خُلَفَآءَ الۡاَرۡضِ ؕ ءَ اِلٰہٌ مَّعَ اللّٰہِ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَذَکَّرُوۡنَ
কে যিনি নিরুপায়ের আহবানে সাড়া দেন যখন সে তাঁকে ডাকে! এবং বিপদ-আপদ দূর করেন। আর তোমাদেরকে যমীনের প্রতিনিধি বানান। আল্লাহর সাথে কি অন্য কোন ইলাহ আছে ? তোমরা কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক”।
ইবাদত ও সাহায্য গ্রহণের সম্পৃক্ততা:
আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর সাহায্য গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সাধারণত চারটা ধরন দেখা যায়।
০১.যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাঁর কাছেই সাহায্য চায়। তারা হচ্ছে প্রকৃত ঈমানদার। রাসূল (সঃ) ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন;-
إذا سألت فاسأل الله ، وإذا استعنت فاستعن بالله،
“যখন তুমি চাইবে, তখন আল্লাহর কাছেই চাও। আর যখন তুমি সাহায্য প্রার্থনা করবে, তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা কর”। – রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ৬৩
আর আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদেরকেই ইবাদতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلٰوةِؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা সবর ও সালাত (ইবাদত) দ্বারা সাহায্য প্রার্থনা করো, আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন”। -আল বাকারা ১৫৩.
০২. একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে কিন্তু সাহায্য গ্রহণে তার পাশাপাশি অন্য কিছুর সাহায্য গ্রহণ করে। যেমন ঐ মুসলিম যে নামাজে দাড়িয়ে ( اِیَّاکَ نَعۡبُدُ وَ اِیَّاکَ نَسۡتَعِیۡنُ ) “আমরা তোমার ইবাদত করি, তোমার নিকট সাহায্য চাই” অথচ আবার মৃত ব্যক্তির নিকট বা মাজারে গিয়েও সাহায্য কামনা করে। তারা গুনাহগার উম্মত। আল্লাহ তায়ালা এরুপ করতে নিষেধ করেছেন।
وَ لَا تَدْعُ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ مَا لَا یَنْفَعُكَ وَ لَا یَضُرُّكَۚ فَاِنْ فَعَلْتَ فَاِنَّكَ اِذًا مِّنَ الظّٰلِمِیْنَ
“আর আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে (সাহায্যের জন্য) ডেকো না, যা তোমার উপকার করতে পারে না এবং তোমার ক্ষতিও করতে পারে না। অতএব তুমি যদি কর, তাহলে নিশ্চয় তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। -ইউনুস:১০৬,
এছাড়াও পবিত্র কুরআনে সুরা ফাতির (১৩-১৪),সূরা আহকাফ(৫-৬), সূরা জ্বিন(১৮) আয়াতে অন্য কিছুর সাহায্য প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
৩ যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্যদের ইবাদাত করে থাকে, কিন্তু তারা বিপদে পড়লে আল্লাহর সাহায্য চায়। এরা আরবের মুশরিকদের মত। এদের ব্যপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন:-
فَاِذَا رَکِبُوۡا فِی الۡفُلۡکِ دَعَوُا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ۬ۚ فَلَمَّا نَجّٰہُمۡ اِلَی الۡبَرِّ اِذَا ہُمۡ یُشۡرِکُوۡنَ
“ অতপর তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে, তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে (সাহায্যের জন্য) ডাকে। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে স্থলে পৌঁছে দেন, তখনই তারা শিরকে লিপ্ত হয়”। – আল-আনকাবূত ৬৫.
৪. এমন সব যারা আল্লাহর ইবাদতও করে না, তার কাছে সাহায্যও চায় না। এরা হচ্ছে নাস্তিক এবং বস্তু বাদি জনগোষ্ঠী। যারা মিথ্যা ধারণা আর অনুমান নির্ভরশীল। আল্লাহ তায়ালা মু’মিনদেরকে এদের অনুসরন করতে নিষেধ করেছেন। এদের ব্যাপারে বলেছেন-
لَا تُطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَهٗ عَنْ ذِكْرِنَا وَ اتَّبَعَ هَوٰىهُ وَ كَانَ اَمْرُهٗ فُرُطًا
“ তুমি এমন কোন লোকের আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার অনুসরণ করেছে এবং যার কর্ম সীমা লঙ্ঘনমূলক”। – আল-কাহাফ:২৮,
শিক্ষা ও প্রায়োগিক ক্ষেত্র:
আলোচ্য আয়াত হচ্ছে তাওহীদের স্বীকৃতি। আল্লাহর একত্ববাদ এর স্বীকৃতি। তাই একজন মু’মিনের সারা জীবনের সমস্ত ইবাদত একনিষ্ঠ তার সাথে একমাত্র আল্লাহর জন্য । মুমিন সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় সকল ধরনের সাহায্যর জন্য আল্লাহর দ্বারস্থ হবে। সালাতের ভিতরে এবং বাহিরে সর্বাবস্থায় সকল শিরক ও তাগূতকে অস্বীকার করে ইবাদত সহ আল্লাহর সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে। তার আনুগত্য ও বন্দেগীর মাধ্যমে তার বান্দা হয়ে থাকবে। সমস্ত সাহায্য একমাত্র আল্লাহর নিকট এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে মু’মিন জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।