প্রশ্ন-উত্তর পর্ব
(১) প্রশ্নঃ অনেক দেশের লোকেরা তাদের নিজেদের ভাষাই ঠিকমতো জানে না এরপরও তারা কুরআন আরবিতে পড়তে শিখে। এ ধরনের লোকেরা কি এটি থেকে কোন উপকার পাবে ? এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আপনি কি উপদেশ দিবেন ?
উত্তরঃ আমি মনে করি এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। সবাই আরবি না বুঝার পরও আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করতে ভালবাসে, আর একারনেই দেখা যায় যে তারা না বুঝেই কুরআন তিলাওয়াত করে। আপনি কুরআন না বুঝে তিলাওয়াত করলেও সওয়াব পাবেন। কুরআন না বুঝে কেবল তিলাওয়াত করাটাও একটা ইবাদাত। এর ব্যাপারে যে দলীল আমরা পাই, সেটি হলো রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সে হাদিস,যেখানে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব থেকে একটি অক্ষর পড়বে তাকে একটি সওয়াব দেওয়া হবে, আর এই সওয়াবকে দশগুণ করা হবে। আমি বলছি না যে ‘আলিফ,লাম,মিম’ একটি অক্ষর, বরং আমি বলছি যে ‘আলিফ’ একটি অক্ষর,’লাম’ একটি অক্ষর আর ‘মিম’ একটি অক্ষর।” (তিরমিযি)
বেশ কিছু সূরা শুরু হয় ‘আলিফ’,‘লাম’, ‘মীম’ – এ তিনটি অক্ষর দিয়ে; কিন্তু এই অক্ষরগুলো দিয়ে আসলে কি বুঝায় ? এমনকি আরবি ভাষীদের বেশীরভাগ লোকই এই অক্ষরগুলো কি অর্থ প্রকাশ করছে তা বুঝে না। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এ অক্ষরগুলো বিশেষভাবে উল্লেখের কারন হলো এই যে, বেশীরভাগ লোকেরই ধারনা নেই এই অক্ষরগুলো দিয়ে আসলে কি বুঝানো হচ্ছে, আর তাই এভাবে বলার মাধ্যমে এটি বুঝানো হলো যে লোকেরা কুরআন না বুঝে তিলাওয়াত করলেও সওয়াব পাবে।
কুরআন তিলাওয়াত করে সওয়াব পাওয়া একটা বিষয়, আরেকটা বিষয় হলো কুরআনকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা। আপনি আরবি শিখুন বা না শিখুন,আরবি জানুন বা না জানুন,কুরআন অনুসরন না করার জন্য সেটি কোন অজুহাত হতে পারে না। কুরআনের আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে জানার জন্য আপনি কুরআনের অনুবাদ পাবেন। আসল সমস্যাটা তো এটিই যে, একজন ব্যক্তি কুরআন কি বলছে তা জানার আর প্রয়োগের চেষ্টা করছে না। সুতরাং একজন ব্যক্তির পক্ষে কুরআনের ভাষা না বুঝা সত্ত্বেও উচিত হবে সওয়াব আর বাস্তবে প্রয়োগের জন্য কুরআন পাঠ করা। ভাষাটি না জেনেও এটি করা যায়। কুরআনের অর্থে তাতাব্বুর হলো এমন একটা ব্যাপার, যা কিনা কুরআনের অনুবাদ পড়েও করা যায়। কিন্তু এটি অবশ্যই কুরআন যে ভাষায় (আরবি) নাযিল হয়েছিলো, সে ভাষায় গভীরভাবে চিন্তা করার থেকে সবসময়ই কম কার্যকর আর অগভীর হবে। তাই লোকদের উচিত হবে কুরআনের ভাষাটি শেখা।
যে ভাষাটি পুরো বিশ্বজুড়ে ব্যবহার করা হয়,যেটা কিনা ইন্টারনেটের ভাষা, যে ভাষার কারনে পুরো বিশ্বে কর্মক্ষেত্রের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায় -যদি দুনিয়ার সে ভাষাটি (ইংলিশ) শেখার জন্য প্রচণ্ড রকম চেষ্টা করা যায়, তবে কেন আমরা এর থেকে বেশি পরিমান চেষ্টা করব না সে ভাষা শেখার জন্য, যেটা কিনা আমাদের পরকালের জীবনের ভাষা ?
আল্লাহ আপনাকে আপনার নিয়্যতের জন্য পুরস্কৃত করবেন। ইবন আল জাওজি (রহ.) বলেন, “হয়তোবা আল্লাহ আপনাকে কোন কাজ করার থেকে সেই কাজের নিয়্যতের জন্যই অধিকতর পুরস্কৃত করবেন।” সুতরাং আল্লাহ আপনার কাছে এটি চান যে, আপনি যেন চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
(২) প্রশ্নঃ সেই ব্যক্তিদের ব্যাপারে আপনি কি বলবেন যারা বলে,“সাহাবীরা যেভাবে কুরআন বুঝেছিলেন আমাদের সেভাবে বুঝার দরকার নেই,আমরা আমাদের নিজেদের মত করেই কুরআনকে বুঝে নিবো ?”
উত্তরঃ আল্লাহ বলেছেনঃ
“(এ সকল নবীকে) আমি সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ ও কিতাব সহকারে পাঠিয়েছি, (একইভাবে আজ) তোমার কাছেও কিতাব নাযিল করেছি যাতে করে যে (শিক্ষা) মানুষদের জন্য তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে তুমি তা তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝাতে পারো,যেন তারা (নিজেরাও একটু) চিন্তা ভাবনা করে।” (সূরাহ আন-নাহল,১৬ : ৪৪)
আমরা কুরআনের ব্যাখ্যা পাই রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছ থেকে। আর রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সরাসরি ছাত্র ছিলেন কারা? সাহাবীরা। তাই সাহাবীরাই হলেন কুরআন বাস্তবায়নের আদর্শিক প্রজন্মের উদাহারন। কুরআন অনুধাবনের জন্য রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিস আর সাহাবীদের জীবনী জানাটা খুবই প্রয়োজন। কোন বই-ই যথার্থ উদাহারন ছাড়া অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আমরা যদি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছ থেকে ব্যাখ্যা গ্রহন না করি আর যদি খুলাফায়ে রাশিদিন যেভাবে কুরআনের আয়াতগুলো বুঝে নিয়েছিলেন তার দিকে না দেখি, তবে আল্লাহর কিতাবের আয়াতগুলো বুঝতে গিয়ে আমাদের মধ্যে প্রচুর পরিমানে মতভেদ দেখা যাবে। কারন আরবি একটি সমৃদ্ধশালী ভাষা,একটি শব্দের ১৫ টি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ থাকতে পারে। আমরা কিভাবে তার অর্থ বুঝতে পারব যদি আমরা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আর সাহাবীদের জীবনীতে ফিরে গিয়ে তাতে দৃষ্টিপাত না করি ?
আল্লাহর নাযিলকৃত আয়াতগুলো পুরোপুরিভাবে বুঝার জন্য আমাদেরকে সেই আয়াত নাযিলের পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝতে হবে। এর একটি উদাহারন হলো এই আয়াতঃ
“… আর তোমাদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।” (সূরা বাকারাহ,২ : ১৯৫)
মুসলিম ও রোমানদের মধ্যে একটি যুদ্ধ চলছিলো। এক মুসলিম সেনা মুসলিম সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হঠাৎ করে রোমানদের দিকে দৌড়ে গেলেন। তিনি রোমান সেনাদের মধ্যে একাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিছু মুসলিম সেনা এটি দেখে বলে উঠলেন,“এই লোকটি তো নিজেই নিজের ধ্বংসের কারন হলো (কারন সে এটি করার মাধ্যমে প্রাণ হারালো)।” আবু আইয়ুব আল-আনসারি (রাঃ) বললেন, “তোমরা এই আয়াতের অর্থ বুঝলে না। এই আয়াত তো আমাদের (আল-আনসারদের) ব্যাপারে বলেছে। আল্লাহ যখন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বিজয়ী করলেন, তখন আমরা বলেছিলাম,“আল্লাহ যেহেতু এখন তার রসূল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বিজয় দান করেছেন, তাই আমরা আমাদের খামার ও ব্যবসাগুলোতে ফিরে যেতে পারবো, যেহেতু রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এখন বিজয়ী।” (নোটঃ আনসাররা ইসলামের জন্য ব্যাপক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন,এমনকি তাদের খামার ও ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছিলো,তাই তারা তখন বললেন যে তারা ফিরে গিয়ে তাদের খামার ও ব্যবসার দেখাশুনা করবেন।) এরপর আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করে আমাদের জানিয়ে দিলেন যে, আমরা যদি তা করি তবে সেটি করার মাধ্যমে আমরা নিজেদের ধ্বংসের কারন হবো। যদিও রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বিজয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু এরপরও আমাদের উচিত হবে না রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ছেড়ে চলে যাওয়া, বরং তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথেই আমাদেরকে থাকতে হবে আর আমাদের ত্যাগ স্বীকার করা চালিয়ে যেতে হবে।”
আর এভাবেই আবু আইয়ুব আল-আনসারি (রাঃ) আমাদেরকে এই আয়াতের সঠিক বুঝটি দান করলেন। তিনি আমাদেরকে এটি না জানালে এই আয়াত সম্পর্কে এই বুঝটি আমাদের হতো না।
(৩) প্রশ্নঃ যেসব ভাই-বোনেরা আরবি বুঝেন না তাদেরকে আপনি কি কি বই অধ্যয়নের পরামর্শ দিবেন ?
উত্তরঃ আমি মনে করি যাদের কাছ থেকে এটি জানতে চাওয়া উচিত, আমি তাদের মধ্যে একজন নই, কারন কুরআন সম্পর্কিত সকল কিতাব আমি আরবিতেই পড়েছি। সুতরাং আমি যা জানি সেটির ব্যাপারেই বলবো, আমি আরবি বইগুলোর ব্যাপারেই বলবো।
কয়েক ধরনের তাফসীর আছে,এর মধ্যে একটি হলো তাফসীর বিল মাশহুর। এ ধরনের তাফসীর কিতাবে কুরআনের তাফসীর করা হয় কুরআনের আয়াত,হাদিস আর সালাফদের উক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে। এই শ্রেণীর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কয়েকটি তাফসীর কিতাব হলো তাফসীরে আত-তাবারী,তাফসীরে ইবন কাসির ও তাফসীরে আশ-শাওকানি। তাফসীরে ইবন কাসির হলো তাফসীরে তাবারীর সংক্ষিপ্ত সংস্করনের মতো একটা তাফসীর কিতাব,যেখানে ইবন কাসির ইসরায়েলি বর্ণনা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাফসীরে তাবারীতে এই ধরনের বর্ণনা প্রচুর দেখা যায়। যদিও ইবনে কাসির তার তাফসীরের কিতাবে তাবারীর মত ব্যাপকভাবে ইসরায়েলি বর্ণনা ব্যবহার করেন নি, কিন্তু তাবারী তার কিতাবে সেগুলোর কিছু বর্ণনা ব্যবহার করেছেন। আশ-শাওকানির তাফসীর কিতাবটি তাফসীর বিল মাশহুর হলেও এতে ভাষাগতভাবেও তাফসীর করা হয়েছে।
আরেক ধরণের কুরআন তাফসীর হলো যেগুলোতে কুরআনের ফিকহ এর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, যেমন ইমাম কুরতুবি রচিত আল-জামি আল-আহকামুল কুরআন।
ভাষাগত তাফসীরের জন্য ইবন আল-জাওজির যা’দ আল-মাসীর কিতাবটি বেশ ভালো। কুরআনের বিভিন্ন শব্দের অর্থ খুঁজে দেখার জন্য এটি বেশ ভালো বই।
কুরআন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা আর ধারণা নিয়ে রচিত কিতাব, যেগুলো কিনা তাফসীরের শ্রেণীবিভাগের মধ্যে পড়ে না কিন্তু সেগুলো কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তার ফলাফল,এমন দুটো কিতাব হলো সায়্যিদ কুতুবের ফি জিলালিল কুরআন আর মাওদুদির তাফহিমুল কুরআন।
তাফহিমুল কুরআন থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলোঃ “এরপরও মনে রাখতে হবে, কুরআনের সারমর্মের পরিপূর্ণ উপলব্ধি তো এটি দাবী করে যে, কুরআন প্রেরণের উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য এর সাথে কার্যকর সম্পৃক্ততা বজায় রেখে প্রবল প্রচেষ্টা করে যেতে হবে। কুরআন কোন দুর্বোধ্য তত্ত্ব ও শীতল মতবাদের কিতাব না যা কিনা এর পাঠক কোন হাতল বিশিষ্ট আরামদায়ক চেয়ারে বসে উপলব্ধি করতে পারবে, আর না এটি অন্যান্য ধর্মের বইগুলোর মত নিছকই একটি বই – যার গোপন রহস্য উপলব্ধি করার জন্য সেমিনার বা বাগ্মিতার প্রয়োজন রয়েছে। পক্ষান্তরে এটি হলো একটি বিপ্লবের উদ্দেশ্যে পাঠানো বার্তার প্রতিচিত্র ও পথনির্দেশিকা। এই কিতাব নাযিল হওয়ার পরেই বিচ্ছিন্নভাবে ও নির্জনভাবে থাকা এক সদয় হৃদয়ের মানুষকে এটি দিয়ে পুরোপুরিভাবেই পরিচালিত করা হলো আর তাকে জীবনযুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে দেওয়া হলো যাতে করে তিনি ভ্রান্তিতে ডুবে থাকা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। এই কিতাব তাকে অনুপ্রানিত করেছিলো মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে আর তাকে স্থির করে দিয়েছিলো কুফরের মানদণ্ডের ধারকদের বিপক্ষে এবং স্রস্টার অবাধ্যতার আর খামখেয়ালিপনা ও ভুল-ভ্রান্তির বিপক্ষে এক কঠোর সংগ্রামে।”
আমি মনে করি তিনি এখানে যা বলেছেন – “কুরআন কোন দুর্বোধ্য তত্ত্ব ও শীতল মতবাদের কিতাব না যা কিনা এর পাঠক কোন হাতল বিশিষ্ট আরামদায়ক চেয়ারে বসে উপলব্ধি করতে পারবে …” –সাহাবীদের ক্ষেত্রে কুরআন অনুধাবন স্বতন্ত্র হওয়ার কারন হলো, তারা কুরআন সাথে নিয়েই বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হয়ে জীবন পরিচালনা করছিলেন, তাদের জীবনের সাথে দাওয়াহ মিশে গিয়েছিলো।
কেউ যদি দাওয়াহ করার সাথে সম্পৃক্ত না থাকে অথবা ইসলামের পথে সংগ্রামের মধ্যে না থাকে, তবে তার কুরআন অনুধাবনের কোন মূল্য নেই। আমি এখন একটি আরামদায়ক বিছানায় বসে পুরো কুরআন পড়ে শুনাতে পারবো,এর আয়াতগুলোর উপর গভীরভাবে চিন্তাও করতে পারবো, কিন্তু এ কাজটা করা আমি বর্তমান সময়ে বেঁচে থাকা কারও জন্য তারিফ করবো না। আমি এমন একটা ঘটনা প্রত্যাহার করতে পারি না যেটা এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। অবশ্য এর সাথে পরোক্ষভাবে যুক্ত কোন ঘটনা প্রত্যাহার করা যায়। উদাহারন হিসেবে তাকদিরের অন্তর্ভুক্ত বিষয় আল-কদরের ব্যাপারে বলা যায়। আল্লাহ বলেছেন,“মৃত্যুর সময়টি এগিয়েও যাবে না বা এতে দেরিও হবে না।” মৃত্যুর সময়টি নির্ধারিত, আর আমরা এই মৃত্যুর ধারনাটি নিয়ে আলোচনা করতে পারি এবং আপনাদেরকে এর উপর ঘণ্টাব্যাপী একটি সিরিজ লেকচারও দিতে পারি যে, আল্লাহ কিভাবে মৃত্যুকে নির্ধারিত করে দিয়েছেন আর আপনি আপনার সেই নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট পূর্বে মারা যেতে পারবেন না বা এক মিনিট পরও বেঁচে থাকতে পারবেন না।
একজন ভাই আমাকে বসনিয়ার একটি ঘটনা সম্পর্কে বললেন। দুই ভাই একটি পরিখার মধ্যে ছিলেন, সার্বস কতৃক নিক্ষিপ্ত একটি মিসাইল তাদের দুজনের মধ্যে ভূপাতিত হয়ে সেটি বিস্ফোরিত হলো আর এক ভাই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। মিসাইলটি সেই ভাইটিকে টুকরো টুকরো করে ফেললো, অথচ অপর ভাইয়ের শরীরে আঁচড়ও পড়েনি,তার কিছুই ঘটলো না! বেঁচে থাকা সেই ভাইটি তার নিজের চোখের সামনেই মৃত্যুকে দেখলেন,তিনি দেখলেন তাদের উভয়ের মাঝে একটি মিসাইল ভূপাতিত হওয়ার পর তার অপর ভাইকে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে। এখন বেঁচে থাকা সেই ভাইকে আল-কদর নিয়ে হাজারটি লেকচার দিলেও তিনি তার চোখের সামনে যে প্র্যাক্টিক্যাল অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন সেটির মত মূল্যবান হবে না সেই লেকচারগুলো। সুতরাং অনেক সময় অভিজ্ঞতা একজন ব্যক্তির উপর খুবই প্রভাব রাখে।
কুরআনের অনেক আয়াতেই সাহাবীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,খন্দকের যুদ্ধের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
“যখন (ভয়ে) তোমাদের চোখ বিস্ফোরিত হয়ে পড়েছিলো,প্রান হয়ে পড়েছিলো কণ্ঠাগত …” (সূরাহ আল-আহযাব,৩৩ : ১০)
আমরা সাহাবীদের সেই অনুভূতি সত্যিকার অর্থে কখনোই অনুভব করতে পারবো না যদি না আমরা তাদের মত সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই। এ কারনেই যারা দাওয়াহ’র কাজ করেন, তারা কুরআনে বর্ণিত নবী-রসূলদের ঘটনা আর দাওয়াহ সম্পর্কিত ঘটনাগুলোর মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন। যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণের মতো কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছেন, তিনি নুহ (আঃ) এর কাহিনী উপলব্ধি করতে পারবেন; যিনি দুর্নীতি,অবক্ষয় ও স্বেচ্ছাচারিতাযুক্ত পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছেন, তিনি লুত (আঃ) এর সংগ্রাম সম্পর্কে আনুধাবন করতে পারবেন; কিন্তু যিনি এসব সংগ্রাম থেকে দূরে থেকে আরামদায়ক পালঙ্কে বসে আছেন আর সত্যিকারের দুনিয়া থেকে দূরে সরে আছেন, তিনি কেবলমাত্র তত্ত্বই অধ্যয়ন করে যাচ্ছেন,আল্লাহই ভালো জানেন।
(৪) প্রশ্নঃ কুরআন তিলাওয়াতের সবচেয়ে সেরা উপায়টি কি ? আমরা কি কেবল সিডি থেকে কুরআন শুনতে পারি আর কুরআন তিলাওয়াতকারীর তিলাওয়াতের অনুসরণ করতে পারি ?
উত্তরঃ এটি নির্ভর করে ব্যক্তি কি আরবিতে কথা বলতে পারেন নাকি পারেন না সেটির উপর। কারন আরবিতে কথা বলেন না, অথবা আরবিতে কথা বলতে পারেন এমন একজন ব্যক্তিও অনেক সময় তাজবিদের আহকাম সম্পর্কে পরিচিত থাকেন না। আমি বলবো যে, শুরুতেই এমন কারও সাথে শেখা গুরুত্বপূর্ণ যিনি তাজবিদের আহকাম সম্পর্কে জানেন। শুরুতেই এটি করার মাধ্যমে ভিত্তি প্রতিষ্ঠা হবে, এরপর ব্যক্তি নিজের মত করে শুরু করতে পারেন। সিডি অথবা টেপে রেকর্ড করা তিলাওয়াত শুনার ব্যাপারটা ভালোই, কারন আপনি আহকামের সাথে তিলাওয়াত শিখতে পারছেন। কিন্তু আপনার যদি আহকাম জানা না থাকে, তবে আপনি তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখতে পারেন, আর সেটি ভুল উপায়ে মুখস্ত করার একটা সম্ভাবনাও থাকে।
সুতরাং এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, কুরআন তিলাওয়াত প্রাথমিক ধাপে এমন কারও সাথে শিখবেন, যিনি তাজবিদের সাথে পরিচিত। আমি এমন লোকের কথাও জানি, যিনি তাদের কাজের ফাকে কুরআন শুনার মাধ্যমে কুরআন মুখস্ত করেছেন। একজন ব্যক্তি সিডি বা টেপ থেকে কুরআন শোনার মাধ্যমে পুরো কুরআন মুখস্ত করতে পারে। সুতরাং আমাদের উচিত আমাদের কর্মক্ষেত্রে আসা যাওয়ার সময়টির সদ্ব্যবহার করা।
(৫) প্রশ্নঃ আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে সরকারের আইন দিয়ে শাসনের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কি হওয়া উচিত, যেহেতু বর্তমানে আল্লাহর কিতাবের প্রয়োগ হচ্ছে না, আর চার্চ ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণের প্রচেস্টার বিশ্বায়ন ঘটছে ?
উত্তরঃ আল্লাহর কিতাবই আমাদের আইন, আর এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে – সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রভাবিত করবে। কুরআন এমন একটি কিতাব যা আমাদেরকে জীবনযাপনের পথ দেখিয়ে দেয়,এই কিতাব কেবলমাত্র আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি এমনই এক ব্যাপার যে, এটি সাথে নিয়ে এটির জন্য আমাদের এখন সংগ্রাম করে যেতে হবে, যেমনটি আপনি বললেন যে আল্লাহর কিতাবের প্রয়োগ হচ্ছে না।
আর একই সাথে আমরা কোন বলির পাঁঠা খুঁজে তার উপর দোষ চাপিয়ে দিতে চাই না। আমি কেবল মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলোকেই আবশ্যকভাবে সমস্যা হিসেবে দেখতে চাই না। মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলো তো আমরাই তৈরি করেছি। আপনাদের পরিস্থিতিই নির্ধারণ করে দিবে আপনাদের শাসকদের পরিস্থিতি। আমরা যদি এদের থেকে অধিকতর ভালো কিছু আশা করি তবে আল্লাহ আমাদেরকে এই অত্যাচারী সরকার দিয়ে শাস্তি দিবেন না, কারন আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ। সুতরাং ব্যক্তি হিসেবে আমাদেরকে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। হ্যা,সবাইকেই দাওয়াহ করতে হবে কিন্তু একই সাথে কুরআন প্রতিষ্ঠা করতে হবে আমাদের নিজেদের জীবনে,আমাদের পরিবারে, আর পুরো সমাজ ও সরকার ব্যবস্থায় আমাদের দাওয়া ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে যে আল্লাহর আইনেরই প্রভাব বিস্তার করা দরকার।
(৬) প্রশ্নঃ সোমালিয়াতে আমরা কুরআন মুখস্ত করি আর আরবিও পড়তে পারি, কিন্তু আমরা আরবিতে যা পড়ছি তা বুঝতে পারি না। এ ধরণের পরিস্থিতির ব্যাপারে আপনি কি পরামর্শ দিবেন ?
উত্তরঃ আপনার ভাষায় পাওয়া যায় বা আপনি জানেন এমন কোন ভাষায় রেফারেন্স পেলে তা ব্যবহার করতে পারেন, আর আরবি শেখার চেষ্টাও করে যেতে পারেন, কারন ইতিমধ্যেই আপনার মধ্যে আরবি বর্ণমালা শেখার ও পড়ার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, আর এটি তো অনেক বড় একটা কৃতিত্ব। আমরা যে আরবি বর্ণমালাগুলো পড়ি সেগুলো একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুতরাং আরবি বর্ণমালা পড়তে ও লিখতে পারা হলো প্রথম ধাপ। আরবি ব্যাকরণ ও শব্দতালিকা জানার জন্য এটি দরকার। কিন্তু কুরআন অনুধাবনের জন্য কারো উচিত হবে না আরবি শেখার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করা। এরপরও আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে এবং আমাদের জানা ভাষাতে আমরা যা কিছু পড়তে পারি সেগুলো পড়তে হবে যাতে করে আমরা যতদূর সম্ভব কুরআন অনুধাবন করতে পারি।
(৭) প্রশ্নঃ ইবন তাইমিয়াহ’র সেই বক্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছিলাম, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে, যদি কেউ আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্য কোন বিধান দিয়ে শাসন করে তবে সে কাফির।
উত্তরঃ আপনি ইবন তাইমিয়াহ (রহ.) এর যে মতামতটি উল্লেখ করলেন, সেটি তো প্রত্যেক জ্ঞানী মুসলিম আলিমদেরই মতামত যে, কেউ যদি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী শাসন না করে তবে সে ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে যায়। এটি এমনই এক ইস্যু যে ব্যাপারে আর কোন বিতর্কেরই অবকাশ নেই।
আপনার প্রশ্ন হলো, এই ধরনের মুসলিম সরকারগুলোর সাথে কিভাবে আচরন করা উচিত। প্রত্যেকটা সম্প্রদায় তাদের নিজেদের ইস্যু সামলায়,এটি গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকায় বসবাসকারী মুসলিম হিসেবে আমাদের সেসব ইস্যু নিয়ে কাজ করতে হবে, যেগুলো উম্মাহ’র সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ইস্যু ও প্রয়োজনীয় (যেমন – এখানকার দাওয়াহ ও এখানকার মুসলিমদের জন্য এখানে প্রতিষ্ঠান তৈরি করা), সেগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। আপনি যদি কোন মুসলিম দেশে বাস করেন, তবে জবাবটি ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু আমাদের উচিত হবে না আফগানিস্তান,মিশর বা অন্য কোন দেশে কারো কি অমুক কাজ করাটি উচিত হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে কোন অনুমান বা ধারনা করা, কারন মুসলিম হিসেবে আমরা সে স্থানে সে পরিস্থিতিতে নেই। আমাদের উচিত হবে নিজেদের সম্প্রদায়ের দিকে নজর দেওয়া, আর এটি করা প্রয়োজন, কারন সে স্থানগুলোর প্রয়োজনগুলো দেখভাল করার জন্য সেখানে মুসলিমরা রয়েছেন।
ব্যাপারটি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝানোর জন্য একটি ঘটনা বলছি। একজন ব্যক্তি ইয়েমেন থেকে এসে উমার ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ) কে বললেন,“আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই,” আর লোকটি তার প্রশ্ন জানালো। উমার (রাঃ) জানতে চাইলেন, “আপনি যেটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন তা কি আসলেই ঘটেছে ?” লোকটি জবাব দিলেন,“না।” উমার (রাঃ) বললেন, “আপনি ইয়েমেনে ফিরে যান, আর আপনি আসবেন এটি ঘটবার পর আসবেন। তখন আমি আপনার জন্য বদর যুদ্ধে অংশগ্রহন করা সব সাহাবীদের একত্রিত করে তাদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করবো, এরপর সে ব্যাপারে আপনাকে জবাব দিবো।”
এই ঘটনা থেকে আমরা দুটো বিষয় শিখতে পারি –
(১) উমার (রাঃ) কাল্পনিক কিছুর পিছে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। যদি আমাদের সাথে ঘটনাটি সম্পর্কিত থাকে তবে আমরা সে ব্যাপারটি দেখবো,আর যদি সম্পর্কিত না হয়, তবে সেটি সম্পর্কিত হওয়ার পরই সে ব্যাপারে আমরা হাত দিবো,এর আগে নয়।
(২) ফাতওয়া দেওয়া কোন সহজ ব্যাপার নয়, আর উমার (রাঃ) এর মতো একজন আলিম এ কথা বলেন নি যে, “আমি তোমাকে জবাব দিবো,” বরং তিনি বললেন আমি আপনার জন্য বদর যুদ্ধে অংশগ্রহন করা সব সাহাবীদের একত্রিত করে তাদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করবো, এরপর সে ব্যাপারে আপনাকে জবাব দিবো।”
মুসলিম দেশের সরকারগুলো যা করছে তা অবশ্যই দুর্নীতি ও মিথ্যা,তারা উম্মাহকে ভুল পথে চালিত করছে আর পথভ্রষ্ট করছে। কিন্তু আমাদের সমস্যাগুলোর দেখাশুনা করা দরকার। আমরা প্রধানত অমুসলিম সমাজে বাস করছি। আমাদের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে স্বাধীনতা রয়েছে। আল্লাহই ভালো জানেন এর কি পরিমান আমাদের থাকবে অথবা কতদিন ধরে এটি চলতে থাকবে, কিন্তু আমাদের কিছু তো আছে। আমাদের স্বাধীনতা আছে কোন প্রতিষ্ঠান গঠন ও সংগঠিত করার, কিন্তু আমরা এটি করছি না।
এখনও আমরা এমন সব ইস্যু নিয়ে লেগে আছি যেগুলোর ব্যাপারে অনেক আগেই আমাদের হাত দেওয়া উচিত ছিলো। বন্ধক রাখার ইস্যুটির ব্যাপারে এখন আমরা জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছি। কেন এমনটি ঘটছে যে আমরা এমন কোন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করছি না যেটা কিনা মুসলিমদের হালাল অর্থায়নের যোগান দিবে ? কেন এমনটি ঘটছে যে এখনও আমরা হালাল-হারাম মাংসের ব্যাপারটি নিয়ে লেগেই আছি, আর এই ব্যাপারে কেনই বা আমরা আগে থেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করি নি ? ইস্যুগুলো বারবার আমাদের সামনে চলে আসছে,সংগঠিত করা আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার সক্ষমতা এবং এই সমস্যাগুলোর দেখভাল করার ক্ষমতা এই উম্মাহ’র আছে,তবে আমরা তা করছি না,কেন ? কারন আমরা কাল্পনিক কিছু সমস্যার পিছে লেগে আছি আর আমাদের বর্তমান সমস্যাগুলোর কোন পরোয়া করছি না।
বার্নার্ড লুইসের একটি উক্তি হলো,“যখন কোন সম্প্রদায় সমস্যাগ্রস্ত হয়, তখন সেটির ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য দুটো উপায় আছে – (১) প্রথমে জানতে হবে আমাদের সাথে কে এমনটি করলো? (২) এরপর জানতে হবে আমাদের সাথে কেন এমনটি ঘটলো? যদি লোকেরা জানতে চায় যে ‘আমাদের সাথে কে এমনটি করল’, তবে তারা তাদের সেই শত্রু খোঁজা শুরু করবে যাতে করে তাদের নিজেদের সমস্যা ধামাচাপা দিয়ে শত্রুর নিন্দা করতে পারে। কিন্তু যদি তারা নিজেদেরকে এই প্রশ্ন করে – ‘আমাদের সাথে কেন এমনটি ঘটলো’, তবে তারা তাদের নিজেদের দুর্বলতা দেখার সমাপ্তি টেনে তাদের সাথে যা ঘটছে সেটির সমাধান খোঁজা শুরু করবে।”
পাশ্চাত্যে বাসকারী মুসলিম সম্প্রদায় হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের ইস্যুগুলোর ব্যাপারে আমাদেরকে যত্নবান হতে হবে, এবং আল্লাহ আমাদেরকে যে সম্পদ,দক্ষতা,জ্ঞান দিয়েছেন আর এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু দেখাশুনার ব্যাপারে এখানে আমাদের যে সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা আছে, সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।
হে আমার ভাই ও বোনেরা,দাওয়াহ করার মাধ্যমে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া ছিলো আম্বিয়াদের একটি বড় ভুমিকা। আমেরিকাতে ছয় থেকে আট মিলিয়ন মুসলিম রয়েছে। আপনি আমেরিকার অমুসলিম লোকদের উপর একটি জরিপ করে দেখতে পারেন, যার ফলাফল হবে এই যে তাদের মধ্যে নব্বই শতাংশ অথবা এর বেশী লোকের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান খুবই কম আছে, অথবা কোন জ্ঞানই নেই। আমরা আসলে কি করছি ? রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) একাই মক্কায় দাওয়াহ করতেন, এরপর এটি পুরো বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং আমাদের সামনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, যেগুলোর ব্যাপারে আমাদেরকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদেরকে আল্লাহর বানী বহন করতে হবে।
দাওয়ার ক্ষেত্রে নবী রসূলদের পদ্ধতি ছিলো এই যে তারা তাদের নিজ সম্প্রদায়ের আসল সমস্যাগুলোর সাথে মোকাবিলা করতেন, আর এই কাজটা খুবই কঠিন। আপনি যখন মানুষদের ভুলগুলো চিহ্নিত করতে পারবেন, তখন তারা সেটি পছন্দ করবে না। এর থেকে সবচেয়ে সহজ আর সুবিধাজনক হলো কারো সমস্যা সম্পর্কে কথা বলা যেটা কিনা মানুষেরা শুনতে পছন্দ করে। আমি যদি এখন দাঁড়িয়ে মুসলিম সরকারগুলোর কুফরের ব্যাপারে খুৎবা দেই তবে মানুষেরা এটি শুনতে পছন্দ করবে। আমি যদি আমেরিকাতে এরকম কোন খুৎবা দেই তবে মানুষেরা এটি পছন্দ করবে আর এটি করাও খুব সহজ। আমি দাঁড়িয়ে বলতে পারি,“ঐসকল রাজা আর প্রেসিডেন্ট সবাই কাফির,” – এটি করা সহজ, কিন্তু এতে মানুষদের কি লাভ হবে ? কিন্তু আমি যদি কোন সমাবেশে তাদের সমস্যার কথা বলি,যার ফলে কোন একজন ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে অপছন্দনীয় হয়ে পড়ে, তবে তারা এটি শুনতে পছন্দ করবে না। আমরা পছন্দ করি বা না করি,এটিই ছিলো নবী রসূলদের দাওয়ার পদ্ধতি।
লুত (আঃ) তার জাতিকে সেটিই বলতে পারতেন যা বলেছিলেন শুয়াইব (আঃ) – “কেন আপনারা ব্যবসার ক্ষেত্রে ন্যায্য নন ?” মাদিয়ানের লোকদের দিকে দেখুন,যারা তাদের ব্যবসার কাজে প্রতারণা করতো। লুত (আঃ) খুবই জনপ্রিয় হতেন যদি তিনি তার জাতিকে এরকম কিছু বলতেন, কারন এটি বলার মাধ্যমে তাদের প্রতিবেশী দেশের খারাপ পরিনতি জানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করলেন না,তিনি তাদেরকে এমন কিছু সম্পর্কে বললেন যা তারা শুনতেই চাইতো না,সেটি ছিলো তাদের বিকৃতি সম্পর্কে। তিনি তাদেরকে বলেছেন সমকামিতা সম্পর্কে ও এর মন্দ পরিনাম সম্পর্কে, আর তারা এটি শুনতে চায় নি।
শুয়াইব (আঃ) তার জাতিকে ব্যভিচার ও অবৈধ যৌন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলেন নি। তিনি তার জাতিকে তাদের ব্যবসায় মন্দ লেনদেনের ব্যাপারে বলেছেন। লোকেরা তার কথা শুনে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। তারা বলল,“ব্যবসার সাথে তোমার ইবাদত আর ধর্মের কি-ই বা করার আছে ? তুমি কেন শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারে কথা বলছো না ? তুমি ব্যবসা করবে কিভাবে ?” – এটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের একটি পুরনো রূপ। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সাম্প্রতিক উদ্ভাবিত কোন মতবাদ নয়,এটি শুয়াইব (আঃ) এর সময় থেকে চলে আসছে। শুয়াইব (আঃ) এর জাতির লোকেরা তাকে বলেছিলো ধর্ম থেকে ব্যবসা পৃথক রাখার জন্য।
(৮) প্রশ্নঃ কুরআনের আয়াত বাসায়,দেওয়ালে,মসজিদে ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ঝুলিয়ে রাখার বিধান সম্পর্কে জানাবেন কি ? আমি শুনেছি এটি করাটা বেমানান,এটি কি সত্যি ?
উত্তরঃ আমার জানা নেই যে এটি বেমানান। আমি মনে করি আপনি যে কারনে এটি শুনেছেন সেটি হলো আমাদের আলোচনায় যা বলা হয়েছে সেটির কারনে,আমরা বলেছিলাম এটি হলো প্রতীকী। কিন্তু কুরআনকে উপকারের কাজে ব্যবহার করতে হবে,কেবল প্রদর্শনের জন্য কুরআন ব্যবহার করা উচিত নয়।
(৯) প্রশ্নঃ কুরআন তিলাওয়াত করতে ইচ্ছুক একজন অনারব শিশু (৪ বছর বয়স) কুরআন তিলাওয়াত করার সময় আয়াতগুলো মিশিয়ে ফেলছে,তার ব্যাপারে অনারব অভিভাবকের কি করা উচিত হবে ? শিশুকে নিরুৎসাহিত না করেই কিভাবে তাকে এটি করা থেকে থামিয়ে রাখা যাবে ?
উত্তরঃ আমি মনে করি এর জবাবটি সহজ। আপনার শিশুকে বলতে পারেন,“এগুলো হচ্ছে আল্লাহর কথা, আর এই কথাগুলো নিয়ে তোমার এমন করাটা ঠিক হচ্ছে না। তুমি আল্লাহর এই কথাগুলো যেমন খুশি সেভাবে উচ্চারন করতে পারো না। তুমি যদি না জেনে থাকো, তবে এতে লজ্জার কিছু নেই যে তোমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করা দরকার।”
আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে সৎ থেকে তাদেরকে শিক্ষা গ্রহন করতে দিন,তারা যদি আয়াত না জানে তবে তাদেরকে থেমে সেটির ব্যাপারে সাহায্য চাওয়ার জন্য বলুন। যেসব শিশুরা দায়িত্বশীলতার বয়সে পৌঁছায় নি,তাদের কুরআন তিলাওয়াতের পদ্ধতি দেখে আমাদের খুব বেশী খুঁতখুঁতে হলে চলবে না। আমাদের উচিত হবে তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমাদের সেরাটাই চেষ্টা করা।
তারা ভুল করতেই পারে, আর আমি বলবো এটা তো রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এ হাদিসের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য – এক ব্যক্তি তার উট হারিয়ে ফেললো। সে তার উট খোঁজা শুরু করলো। সে মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো, কারন মরুভূমির মধ্যবর্তী জায়গায় তার উট হারিয়ে ফেলার মাধ্যমে তার পরিবহন আর সম্পদ চলে গেলো। এরপর তার উট তার কাছে ফিরে আসলে সে আনন্দের আতিশয্যে আল্লাহ্কে বলে উঠলো,“আপনি আমার গোলাম আর আমি আপনার রব।” অথচ তার তো বলার কথা ছিলো “আমি আপনার গোলাম আর আপনি আমার রব।” সে এমন একটি ভুল করলো যা একটি শিরক। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“এই ব্যক্তির উট ফিরে আসার পর সে যেমন খুশি হয়েছে,আল্লাহ তার বান্দার তাওবা করার কারনে তার থেকেও বেশী খুশি হোন।” সুতরাং কোন শিশু কুরআন তিলাওয়াত করতে গিয়ে ভুল করলে তাদেরকে সংশোধন করে দিতে হবে, আর এই ভুলটা যে কঠিন একটি ভুল, সেটি তাদের বুঝাতে হবে, কিন্তু তাদেরকে কখনোই কুরআন তিলাওয়াতে নিরুৎসাহিত করা যাবে না।
(১০) প্রশ্নঃ কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার আর সেগুলো আমাদের জীবনে প্রয়োগ করার ধাপগুলো কি কি ? এ ব্যাপারে আমরা কিভাবে এগুবো?
উত্তরঃ প্রথমে আপনাকে কুরআন সঠিকভাবে অনুধাবনের ব্যাপারে নিয়্যত ঠিক করতে হবে, যা কিনা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। আল্লাহর কিতাব বুঝে বুঝে তিলাওয়াতের সিদ্ধান্ত ও নিয়্যত হলো অনেক একটি বড় ধাপ – “হে আল্লাহ,আমি আপনার কিতাবটি অনুধাবন করতে চাই, আর আমি সেটি করতে যাচ্ছি,” এটি আপনার জন্য দরজা খুলে দিবে। কারন আমাদের বুঝের পিছনে কিছু অপরিহার্য ব্যাপার রয়েছে, যেহেতু এটি আল্লাহর বানী। আল্লাহ বলেছেন,“আল্লাহ্কে ভয় করো,আল্লাহ তোমাকে শিক্ষা দিবেন।” আমাদের মধ্যে যখন তাকওয়া আসবে তখন আল্লাহ আমাদের অন্তরগুলো উন্মুক্ত করে দিবেন আর তার জ্ঞান থেকে আমাদের নূর দান করবেন।
দ্বিতীয়ত,আমরা যখন কুরআন তিলাওয়াত করবো,তখন সূরা,জুয বা কুরআন শেষ করার দিকে আমাদের মনোযোগ দিবো না, বরং আমাদের মনোযোগ থাকবে আমরা যা তিলাওয়াত করছি সেটির দিকেই। ইবন সাউদি বলেছেন,“যখন তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, তখন তোমাদের এমনভাবে তিলাওয়াত করা উচিত হবে না যেন তোমরা সবজি বিক্রি করছো (সবজি বিক্রেতা সবজি বিক্রি করার সময় চিন্তা করতে থাকে যে কখন তার সব সবজি বিক্রি করা শেষ হবে) – কুরআনের সাথে তোমাদের এভাবে আচরন করাটা উচিত হবে না। তোমরা যে আয়াতগুলো তিলাওয়াত করবে, কেবল সেগুলোর ব্যাপারেই তোমাদের চিন্তাভাবনা করা উচিত হবে।”
তৃতীয়ত,অবিরতভাবে তিলাওয়াত করা,সবসময় তিলাওয়াত করা। আল্লাহর কিতাব বিভিন্ন অধ্যায়ে ভাগ করা হয় নি (যেমন একটি অধ্যায় কাহিনী সম্পর্কে,একটি অধ্যায় আইন সম্পর্কে ইত্যাদি)। সবকিছুই একসাথে করা হয়েছে। উদাহারন হিসেবে সূরা তালাক থেকে একটি আয়াত দেখি,সেই আয়াতে পারিবারিক আইন ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রের ব্যাপারে বলা হয়েছে। আপনি যখন সবসময়ই কুরআনের কাছেই থাকবেন,আপনি তিলাওয়াত করার সময় এমন কিছু পাবেন যেন সেটি আপনাকেই উদ্দেশ্য করে বলছে। এর কারন হলো আল্লাহর কিতাব আপনার সাথে কথা বলছে। কুরআনের সাথে আপনার একটি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে,আল্লাহই ভালো জানেন। এটি প্রায়ই লোকদের ক্ষেত্রে ঘটে যে, যখন তারা কোন বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান, সে পরিস্থিতে তারা কোন নির্দিষ্ট আয়াত তিলাওয়াত করেন।
কিছু সাহাবীর ক্ষেত্রে ও এমনটি ঘটেছিলো যখন এই আয়াত নাযিল হলো – “ইমানদারদের জন্য কি এখনও সে সময়টি আসেনি যে আল্লাহর (আযাবের) স্মরণে আর আল্লাহ যে সঠিক (কিতাব) নাযিল করেছেন তার স্মরণে তাদের অন্তরসগুলো বিগলিত হয়ে যাবে …” (সূরাহ হাদিদ,৫৭ : ১৬) – তখন কিছু সাহাবী এই আয়াত শুনে বিস্মিত হলেন, কারন তার মনে করেছিলেন যে তারা ইতিমধ্যেই ঈমানদার বান্দা, কিন্তু তারা জানতেন না যে এমনকি তাদের জন্যও এটি মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন আছে,যা আল্লাহ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে তাদের মনে করিয়ে দিলেন। আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
(১১) প্রশ্নঃ অমুসলিমরা অপবিত্র থাকার পরও কি তাদেরকে কুরআনের অনুবাদ দেওয়া যাবে ?
উত্তরঃ প্রথমত,আমাদের এখানের (পাশ্চাত্যের) পরিস্থিতিতে এ ব্যাপারে আমরা এমন সব লোকদের মুখোমুখি হয়েছি যারা ইংলিশে কুরআন পড়েন, আর এটিকে তো কুরআন হিসেবে বিবেচনা করা হয় না (অনুবাদকের নোটঃ বরং একে কুরআনের অনুবাদ বলা হয়, কুরআনের অনুবাদই কুরআন নয়)। সুতরাং কুরআনের ব্যাপারে যেসব বিধান আছে তা এখানে খাটছে না। আপনি যদি তাদেরকে কুরআনের এমন কপি দেন যেটাতে আরবি আছে, তবে আমি যে ফিকহের মতামতটির অনুসরণ করি সে অনুসারে বলতে পারি, যদি কপিটির বেশীরভাগ অংশই এর তাফসীর বা অনুবাদ হয়ে থাকে, তবে সেটিকে মুসহাফ (কুরআনের লিখিত রূপ) বলা যাবে না।
উদাহারন হিসেবে বলা যায়,আমরা যদি এমন প্রতিটি জিনিষ – যেগুলোতে আল্লাহর আয়াত লিপিবদ্ধ করা আছে, সেগুলোর উপর তাহারাতের (পবিত্রতার) বিধান প্রয়োগ করি, তবে তাফসীরের প্রতিটি কিতাব,আরবিতে রচিত অনেক কিতাব আর প্রতিটি আরবি সংবাদপত্র যেগুলোতে সাধারণত কুরআনের একটি আয়াত থাকে –এগুলো স্পর্শ করার পূর্বে কি আমাদেরকে ওযু করে নিতে হবে ? না,যতক্ষন না পর্যন্ত এগুলোর অর্ধেকের বেশী অংশে আল্লাহ কিতাবের আয়াত দেখা যাবে না, ততক্ষন পর্যন্ত একে কুরআন হিসেবে গণনা করা যাবে না। এর থেকে ভালো একটি বিকল্প আছে, সেটি হলো তাদেরকে কুরআনের এমন অনুবাদ দেওয়া, যেটাতে আরবিতে আয়াত নেই,আর এটি বর্তমানে সহজলভ্য।