তখন আমি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে।
সেখানেই বন্দি ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী নাহিদ ভাই। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে নাহিদ ভাই আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নাহিদ ভাইয়ের সাথে বেশ সময় কাটাতাম।
একদিন কথা প্রসঙ্গে বললেন- ”নূর, সব আমার কপালের দোষ। বিশ্বজিৎ ছেলেটা যদি হিন্দু না হয়ে জাস্ট মুসলমান হতো, তাহলে খেলাটা উল্টে যেত। বিপদে পড়ে গেছি ছেলেটা হিন্দু, নামের আগে ‘শ্রী’ আছে। কোনোভাবে যদি ‘মুহাম্মাদ বিশ্বজিৎ’ হতো, তাহলে ক্যাম্পাসে শিবির প্রতিহত করার পুরস্কারে আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি পদের শক্ত দাবিদার থাকতাম। দুর্ভাগ্য ছেলেটা হিন্দু বলে শিবির বলে চালিয়ে দেওয়া গেল না; আর মিডিয়াও লেগে গেল। ছাত্রশিবির কর্মী হলে এভাবে মিডিয়া পেছনে লাগত না; বরং এই ভিডিও ফুটেজ আমিই সংগ্রহ করে কেন্দ্রে জমা দিয়ে পোস্ট বাগিয়ে নিতাম।”
নাহিদ ভাই ঠিক এভাবেই আমাকে বলেছিলেন। বিশ্বজিৎ হিন্দু বলে চিপায় পড়ে তিনি কারাগারে বিচারের মুখোমুখি; তার দুনিয়াটা সত্যিই বদলে গিয়েছিল।
পাপিয়া সুন্দরী।
ক্যাসিনো সম্রাট-খালিদ।
এনু-রূপণ আল গেণ্ডারিয়া।
ক্রসফায়ার প্রদীপ।
ধর্ষক এমসির কৃতিসন্তান।
দাঁত ফেলানো ইরফান সেলিম।
এসব মানুষ আসলে চিপায় পড়ে গেছে।
বিশ্বাস করুন, বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদে এমন ‘বীরসৈনিক’ তৈরি হয়ে আছে। এই স্ট্যাটাস যখন পড়ছেন, তখনও আপনার এলাকায় কোনো না কোনো সরকার দলীয় ‘মহান নেতা’ বীভৎস অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে সোৎসাহে। ভয়ে, লজ্জায়, ঘৃণায় মানুষ মুখ বন্ধ করে আছে। পাপের আতিসাহ্যে মাইক্যা চিপায় পড়লে সবাই তাদের ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে।
পাপীরা কনফিডেন্সের আতিশায্যে তাদের নিজ বলয়ের ভেতরেই যখন হাত দিচ্ছে, তখন খেলা উল্টে যাচ্ছে। এমপি সেলিম পুত্র ইরফান সেলিম নেভি অফিসারের দাঁত উপড়িয়ে ফেলার পরে তাৎক্ষণিক বিচারের মুখোমুখি হলো। কিন্তু মাত্র কয়েকদিন আগে যাত্রাবাড়িতে বিএনপির এমপি প্রার্থী সালাউদ্দিনের দাঁত ফেলে দেওয়া হলো প্রকাশ্যে; কই কিছু তো হলো না! আচ্ছা, নেভি অফিসারের পরিবর্তে যদি আমাকে ধাক্কা মারত অথবা আমার দাঁত উপড়িয়ে ফেলা হতো, তাহলে কি পরবর্তী ঘটনাগুলো এমন হতো?
মেজর সিনহার পরিবর্তে সেদিন যদি আমি গুলি খেতাম, পরবর্তী সিকোয়েন্স কি এমন হতো? মেজর সিনহার আগেও তো অনেকে ক্রসফায়ারে মরেছে, কমিশনার মেয়ের ‘আব্বু তুমি কাঁদছো কেন’ শুনেছি তো; কই তখন তো প্রদীপ বাবুর কিছু হয়নি। বরং, আমি মরলে আপনারা বলতেন ইয়াবা ব্যবসায়ী।
ক্যাসিনো সম্রাট কিংবা খালিদেই খেলা শেষ কি? চোখ মেলে দেখুন- আপনার পাশেই অসংখ্য সম্রাট-খালিদ। কত শত পাপিয়া চারপাশে দৃশ্যমান। সরকার দলীয় ইউনিট পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও কতটা দাপটে চলছে, একটু খেয়াল করে দেখুন।
কেন এমন হলো?
কেন এমন ভারসাম্যহীন এক বাংলাদেশ তৈরি হলো?
৩০ ডিসেম্বর (২৯ ডিসেম্বর) রাতে একটা ভয়ংকর বাংলাদেশ নির্মাণ করে ফেলেছি আমরা। সেদিন সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে এক ন্যাক্কারজনক ইতিহাস তৈরি হয়েছে। সেদিন থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আর কাউকে হিসাবে গোণে না।
আমি তৃণমূলের একটা ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজনীতি করি। সেখানে দেখি, একেবারে অশিক্ষিত, গণ্ড মুর্খ, নোংরা চরিত্রের, প্রতারক, মানসিক রোগী পর্যায়ের মানুষ ভদ্র মানুষদের অপমান করছে, ডমিনেন্ট করছে, হুমকি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী; প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষের গণ্ড মুর্খ কর্মীরা ঘোষণা করছে, ভোট যে-ই পাক, তারা চেয়ারম্যান। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা না করে পান থেকে চুন খসলেই হুমকি দিচ্ছে- তোকে পুলিশ দিয়ে তুলে দেবো। জনপদের ভদ্র মানুষরা কতটা নির্বাক, অসহায়, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।
বিশ্বাস করুন, এমনটিই হচ্ছে। আমার এই স্ট্যাটাস প্রশাসন যন্ত্রের কারও নজরে আসলে গোস্বা হবেন হয়তো। কিন্তু যেমনটি বলছি, একটু তথ্য নিয়ে দেখুন। প্রশাসনের নাম ব্যবহার করে কীভাবে একটা ভয়ংকর জনপদ গড়ে উঠছে প্রতিটি অঞ্চলে। অনেকক্ষেত্রেই প্রশাসন আগ বাড়িয়ে জুলুম করছে না; কিন্তু অতি আত্মবিশ্বাসে সরকার দলীয় লোকজন এক বীভৎস পরিবেশ গড়ে তুলছে। আমি আমার এলাকায় দেখেচি, প্রশাসন মোটামুটি নিরেপেক্ষ; আমাদের ভালো কাজে হস্তক্ষেপ করছে না। কিন্তু অব্যাহতভাবে সাধারণ মানুষ মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে মনে হয়, এই জনপদে রাজনীতিই করব না, যতদিন সমাজ নতুন করে নির্মিত না হচ্ছে, ততদিন নিরব থাকব। আবার ভাবি, আমরা যদি লড়াই থামিয়ে দেই, তাহলে কাদের হাত ধরে পরিবর্তন আসবে? নিরবতাই তো চূড়ান্ত সমাধান নয়। বরং, আমরা আমাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করি, সর্বোচ্চ মূল্য চুকিয়ে দেই; পরবর্তী প্রজন্ম যেন ভালো একটা সমাজের মুখোমুখি হয়।
অবশ্যই আমাদের সমাজকে এই ভয়ংকর জায়গা থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এ সমাজব্যবস্থা কখনোই শুভ পরিণতি ডেকে আনবে না। এমনটি চলতে থাকলে প্রত্যেককে বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। মেজর সিনহা কিংবা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিকই শেষ নয়; এই দখলদার নেতাকর্মীদের মুখোমুখি হবেন অনেকেই। এমসি কলেজের হোস্টেলে এক গৃহবধূ গ্যাং রেপ-এর মুখোমুখি হয়েছে; এটা দৃশ্যমান হয়েছে বলে একমাত্র ঘটনা নয়। অহরহ এমন ঘটনা ঘটছে, ঘটবে।
সত্য তো এটাই- আজকের বাংলাদেশ বিরোধীদল শূন্য। তবুও কেন দেশ এভাবে চলছে? এখন তো এক নেতার এক দেশ। তবুও কেন এত অস্থিরতা আর বিশৃঙ্খলা? তথ্যমন্ত্রীর মতো বলবেন না প্লিজ, সব বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র। এভাবে বললে এক অসুস্থ সমাজের ভিত্তি আরও মজবুত হবে।
দেশটাকে বাঁচান। অসুস্থ-বিকৃত রুচির মানুষদের আর স্পেস দিবেন না প্লিজ। একটা দলের জন্য দেশটাকে জাহান্নাম বানাবেন না প্লিজ।
এই দেশটা আমাদের; চলুন নতুন করে নির্মাণ করি।