তাঁর জানা ছিল, হাইকোর্টে ন্যায়বিচার পাওয়া যায়। তিনি এই আদালতেরই কর্মচারী। তাই গতকাল দুই যমজ নবজাতকের চিকিৎসার জন্য পাঁচ ঘণ্টায় তিনটি হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি করাতে না পেরে তিনি তাদের নিয়ে ছুটে যান হাইকোর্টে। ততক্ষণে নবজাতকরা বেঁচে নেই। অ্যাম্বুল্যান্সে নবজাতকের মরদেহ নিয়ে হাইকোর্ট চত্বরে মিনিট ১৫ অবস্থান করে অসহায় ওই পিতা ছোটেন কবরস্থানে। এরই মধ্যে ঘটনা জেনে দুই বিচারপতির হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই তিন হাসপাতালের প্রতি শিশু দুটিকে ভর্তি না করার কারণ ব্যাখ্যার আদেশ দেন।
আদেশের কপি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল এবং মুগদা ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের পরিচালকদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কারণ জানাতে হবে।
স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল সোমবার এই আদেশ দেন। একই সঙ্গে শিশু দুটির চিকিৎসা অবহেলায় বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। আদালতের এই আদেশের তথ্য সাংবাদিকদের জানান সংশ্লিষ্ট আদালতে দায়িত্বরত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
ডেপুটি অ্যাটর্নি আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, সোমবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের এমএলএসএস মো. আবুল কালাম আজাদের সন্তানসম্ভাবনা স্ত্রী সায়েরা খাতুন অসুস্থ হয়ে পড়েন। আজাদ তাঁকে নিয়ে অটোরিকশায় করে ছোটেন বাসার কাছের হাসপাতালের দিকে। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছার আগেই অটোরিকশার মধ্যেই জন্ম হয় অপরিণত দুটি পুত্রসন্তানের। এরপর নবজাতক দুটি এবং তাদের মাকে নিয়ে যান মুগদা ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রসূতিকে ভর্তি রেখে নবজাতক দুটিকে শিশু হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ হিসেবে বলা হয়, নবজাতকদের রাখার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
এরপর একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে নবজাতক দুটিকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে যান আবুল কালাম আজাদ। শিশু হাসপাতাল থেকে বলা হয়, তাদের এনআইসিইউ খালি নেই। নরমাল বেডে ভর্তি করতে হবে। তবে এ জন্য প্রতিদিন প্রতি বাচ্চার জন্য পাঁচ হাজার করে টাকা লাগবে। একথা শুনে হতবিহ্বল আজাদ ফোন করেন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারকে। বিচারপতি তাঁকে নবজাতকদের নিয়ে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে যেতে বলেন। পরামর্শমতো আজাদ নবজাতকদের নিয়ে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে যান। তিনি হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে গিয়ে তাঁকে না পেয়ে কথা বলেন পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার সঙ্গে।
এরপর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার নিজেও ওই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন। পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জানান, পরিচালক মিটিংয়ে আছেন। এ সময় ওই ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে নবজাতক দুটিকে দ্রুত ভর্তির ব্যবস্থা করতে বলেন বিচারপতি। একটু পরই ওই কর্মকর্তা জানান, পরিচালক মিটিং শেষ করে বাসায় চলে গেছেন। এরপর ওই কর্মকর্তা অন্য একজন চিকিৎসক ডেকে অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যেই নবজাতক দুটিকে দেখার ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসক নবজাতক দুটিকে দেখে বলেন, ওরা আর বেঁচে নেই।
তারপর আজাদ অ্যাম্বুল্যান্সে করে তাদের মরদেহ আদালত চত্বরে নিয়ে আসেন। ঘটনা বিচারপতিকে জানিয়েই আবুল কালাম নবজাতক দুটিকে দাফনের জন্য মুগদা কবরস্থানে যান। সেখানেই নবজাতক দুটিকে দাফন করা হয়েছে। এরই মধ্যে আদালত খাসকামরায় বসে আদেশ দেন।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যতটা জেনেছি, ওই শিশু দুটির জন্ম হয়েছিল ২০ সপ্তাহের মাথায়। এই সময়ের কোনো শিশুর মাতৃগর্ভের বাইরে হার্ট সচল থাকার কথা নয়। আমাদের ডাক্তার অ্যাম্বুল্যান্সে গিয়ে শিশু দুটির দেহ ঠাণ্ডা পেয়েছেন। আগেই মারা গেছে; কিন্তু ঠিক কখন মারা গেছে তা ঠিক বলা যায় না।
তবু আমরা হাইকোর্টের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাঁদের চাওয়া অনুসারে ব্যাখ্যা দেব।’
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহম্মেদ মুয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘটনা শোনার পরে আমি তৎক্ষণাৎ খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি ওই শিশু দুটিকে এখানে নিয়ে এসেছিল। তবে কোনো টিকিট বা কোনো ডকুমেন্ট পাওয়া যায়নি। এ জন্য আমি নিজেই বিষয়টি তদন্ত শুরু করেছি। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের আদেশ সম্পর্কে অবহিত হয়েছি তবে এখনো কপি পাইনি। কপি পেলে বিস্তারিত দেখে সে অনুসারে ব্যবস্থা নেব।’