‘করোনাকালের এক ভোরবেলায় পাখির ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। জানালায় উঁকি দিয়ে দেখি, বাসার চারপাশে গাছের ডালে প্রচুর পাখির আনাগোনা। বারান্দায় পাখির অস্থির কিচিরমিচির। ভাবি, হয়তো পাখিরা সমস্যায় আছে। কয়েক বাটি চাল নিয়ে রান্নাঘরের ছাদে ছিটিয়ে দিই। পাখিগুলো খাবারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। পেট ভরে খেয়ে একসময় উড়াল দেয় পাখিগুলো। ভাবি, ওরা কোথায় গিয়ে নির্ভয়ে থাকে। মানুষের বসবাসের জন্য আমরা কত-কী করি! কিন্তু পাখিরা আমাদের পরিবেশের জন্য ওদের সাধ্যমতো সহায়তা করছে; এতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে। অথচ ওদের জন্য আমরা কিছুই করছি না। এসব ভাবতে গিয়ে আমি পাখির জন্য অভয়ারণ্যের চিন্তা করি।’ কথাগুলো কালের কণ্ঠকে বললেন পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খালেদা খাতুন রেখা।
পাখি বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, বাঁচবে মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশের উপকূলে পাখিরা বিপন্ন। নানা জাতের পাখি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের পাখি শিকার আর দুর্যোগ এর অন্যতম কারণ। পাখির জন্য তাই দরকার নির্ভয় পরিবেশ। আর এই পরিবেশ সুরক্ষায় এগিয়ে এসেছেন ইউএনও রেখা। পাখির জন্য অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে নীরবে কাজ করে চলেছেন তিনি। প্রশাসনিক কাজে শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিজ বাসার ছাদে প্রতিদিন পাখিদের খাবার বিলান। গাছে গাছে বাঁধেন পাখির জন্য বাসা। পাখি শিকার বন্ধে নিয়েছেন উদ্যোগ। এসব কাজের জন্য তিনি এলাকায় পরিচিত পাখিপ্রেমী হিসেবে।
কাউখালী উপজেলা পরিষদসহ শহরের আনাচকানাচে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, আবাসন এলাকা ও ইকোপার্কের গাছের ডালে ডালে এখন দেখা যাচ্ছে ইউএনওর বাঁধা পাখির বাসা। মাটির তৈরি হাঁড়ি সদৃশ এসব বাসায় পাখির নির্ভয় আশ্রয় মিলছে। সম্প্রতি কাউখালী সরকারি কলেজের গাছে উঠে মাটির তৈরি পাখির বাসা বাঁধছিলেন ইউএনওর অফিস সহকারী মো. সুমন মিয়া। আর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বাসাগুলো সুমনের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন ইউএনও।
সুমন মিয়া বলেন, ‘আমার স্যার (ইউএনও) উপজেলা শহরের বিভিন্ন গাছে সহস্রাধিক পাখির বাসা বেঁধেছেন। আমি স্যারের এমন কাজে সাহায্য করে দারুণ আনন্দ পাচ্ছি। পাখি বাঁচানোটাও ভীষণ সুখ। আমি স্যারের পরামর্শে সবাইকে রোজ অনুরোধ করছি কেউ যাতে পাখি হত্যা না করে।’
পরিবেশপ্রেমী ইউএনও খালেদা খাতুন রেখা বলেন, ‘ওই দিন ভোরের ঘটনার পর আমার ক্ষুধাকাতর পাখির জন্য মায়া বাড়তে থাকে। একদিন সন্ধ্যা নদীর তীরের সোনাকুর মৃৎপল্লী থেকে বেশ কিছু মাটির হাঁড়ি কিনে আনি। তারপর সুন্দর করে কেটে গাছের ডালে বেঁধে পাখির বাসা তৈরি করি। নিজের সরকারি বাসভবন থেকে শুরুটা হয়। এখন পাখির বাসা ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলা সদরের কলেজপাড়া, ইকোপার্ক, আবাসন এলাকায়। আমার এক সহকর্মী সুমন মিয়া এ কাজে কঠোর পরিশ্রম করে আমাকে এগিয়ে দেন।’
ইউএনও আরো বলেন, ‘আমরা মানুষের জন্য কত-কী করছি। এর পরও মানুষের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। কিন্তু পাখিগুলোর মনে কী কষ্ট, কী ওদের চাহিদা, তা আমরা জানি না। ওরাও পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে। মানুষের মতো পশুপাখিরও মৌলিক অধিকার রয়েছে। এসব মানুষের অন্তর্গত উপলব্ধির বিষয়। আমি আমার কর্ম এলাকায় পাখি শিকার বন্ধে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। কেননা এই প্রাণ ও প্রকৃতি আমাদের সুন্দর বেঁচে থাকার জন্য জরুরি।’
কাউখালীর উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আব্দুল লতিফ খসরু বলেন, ‘আমাদের পরিবেশে পাখিদের নির্ভয়ে বেঁচে থাকা জরুরি। পাখি বাঁচলে পরিবেশ সুন্দর থাকবে। পাখি বাঁচানোর জন্য কাউখালী ইউএনওর উদ্যোগ এখন উপজেলার মানুষের মুখে মুখে।’
কাউখালীর সংস্কৃতিজন ও শিক্ষক নেতা সুব্রত রায় বলেন, ‘আমাদের ইউএনও একজন জনবান্ধব কর্মকর্তা হিসেবে এলাকায় সমাদৃত। পাখির জন্য আহার বিলিয়ে ও আশ্রয় গড়ে তিনি মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।’
পিরোজপুর জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘পাখি আমাদের প্রাণবৈচিত্র্যের অংশ। পরিবেশে পাখি বেঁচে থাকা ভীষণ জরুরি। পাখির জন্য মানুষের মমত্ববোধ থাকাও জরুরি। একজন ব্যস্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তার পাখি সুরক্ষার উদ্যোগের বিষয়টি একটি দৃষ্টান্ত। আশা করছি, সাধারণ মানুষও পাখি রক্ষায় উদ্বুদ্ধ হবে।’
জানা গেছে, সহজ-সরল মানুষ হিসেবে পরিচিত ইউএনও খালেদা খাতুন রেখা করোনাকালে
কর্মহীন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ ও সরকারি বই পৌঁছে দিয়েছেন। প্রশাসনিক কাজের বাইরে অসহায়, পথহারা মানুষকে সেবা দেওয়াসহ নানা কাজ করে চলেছেন তিনি।