জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী প্রয়াত এন্ড্রু কিশোর দরাজ কণ্ঠে গেয়েছিলেন ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরালে ঠুস…’। এখনো সেই গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সেই ‘দম ফুরানো’ মানুষদের নিয়েই তাঁর ধ্যানজ্ঞান, জীবিকার টান। অদম্য সাহসে লাশে মমতার হাত রেখে পার করেছেন এক যুগ। ৩২ বছরের ছোট জীবনে মনের ফ্রেমে এঁকে রেখেছেন রঙিন দুনিয়ার পাট চুকিয়ে ফেলা অসহায় অনেক লাশের ছবি। তিনি লাশের শেষ সময়ের সঙ্গী। নাম আবুল বাশার। রাজধানীর বুকে খুঁজে ফেরেন লাশ। তাই সবাই তাঁকে ডাকে ‘লাশের বন্ধু’।
বুকে সাহস, হৃদয়ে ভালোবাসা : সালটা ২০০৯। সেই সময়ে ২০ বছরের টগবগে তরুণ বাশার জীবিকার টানে বরগুনা থেকে নোঙর করেন জাদুর শহর ঢাকায়। চাকরি খুঁজতে খুঁজতে থিতু হন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের আঙিনায়। সেই দিনের কথা বাশারের হৃদয়ের আয়নায় আজও অমলিন। ২৯ জন বসেছিলেন সাহসের পরীক্ষায়। মর্গে ক্ষতবিক্ষত বিকৃত লাশ দেখে ‘দম’ ধরে রাখতে পেরেছিলেন মাত্র তিনজন। এর মধ্যে একজন বাশার। সেই সময় থেকে সাহসিকতা আর মানবিকতার মিশেলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের হয়ে লাশ টানছেন তিনি। পাক্কা হিসাবও আছে তাঁর। ১২ বছরে ২০ হাজারেরও বেশি লাশে রেখেছেন ভালোবাসার হাত। ফলে দেশের ৬৪ জেলায়ই লাশ নিয়ে ঢুঁ মারতে হয়েছে তাঁকে। সেই সময়ে দেখেছেন মানুষের শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর স্বজনদের সাদাকালো অসহায়ত্ব। অন্যদিকে লাশ নিয়ে স্বজনদের নানামুখী অবজ্ঞা অজান্তেই তাঁর চোখে জমিয়ে দিয়ে যায় নোনা জল।
লাশের সঙ্গে দিবারাত্রি : দিন-রাতের বেশির ভাগ সময়ই বাশারের কাটে লাশের সঙ্গে। ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ধস, তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন, সাভারের আমিনবাজারে ব্রিজ ভেঙে বাস দুর্ঘটনা, পাটুরিয়ায় লঞ্চডুবিসহ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহত অনেক মানুষের লাশ আবুল বাশারের হাত হয়ে গেছে কবরে। সাধারণ লাশের পাশাপাশি পচাগলা, বিকৃত, মাথাহীন কিংবা টুকরা লাশও তিনি উদ্ধার করেন নিয়মিত। বাশারের রুটিন কাজের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে সপ্তাহে দু-তিনটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে লাশ নিয়ে আসা অন্যতম। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে টেনেছেন বেশি বেওয়ারিশ লাশ। আর সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে যে লাশগুলো আনেন সেগুলোর বেশির ভাগই থাকে পচাগলা ও বিকৃত। আগে যেখানে বাশার সপ্তাহে ৩০টির বেশি লাশ নিয়ে আসতেন এখন তা ১৫-তে নেমে এসেছে। জানালেন, এখন বেওয়ারিশ লাশ শনাক্তের অনেক সুযোগ হয়েছে। তাই সংখ্যাটাও কমেছে। এ ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানা থেকে আইনি প্রক্রিয়া শেষে দেওয়া বেওয়ারিশ লাশগুলো নিয়ে আসেন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের আঙিনায়। পরে আঞ্জুমান মুফিদুলের নির্ধারিত কবরস্থান জুরাইন, বসিলা ও আজিমপুরে নিয়ে দাফন করা হয়।
অন্য রকম এক চরিত্র : বাশারকে নিয়ে কথা হয় আঞ্জুমান মুফিদুলের কাকরাইল অফিসের ডিউটি কর্মকর্তা রুহুল আমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, লাশ টানার কাজটি একই সঙ্গে সাহস ও সওয়াবের। এটা সবাইকে দিয়ে হয় না। এ কাজে এসে দুনিয়ার প্রতি যেসব ক্ষণিকের মোহ থাকে, অনেকের সেটা চলে যায়। বাশারও এ রকম একটি চরিত্র। তাঁকে কখনো কাজে ফাঁকি দিতে দেখিনি। সাহসিকতার সঙ্গে লাশ টানার কাজ করছেন এক যুগ ধরে।’
বাশারের চাওয়া : এই কাজ করে জীবনচাকা সচল রাখলেও বাশার চান বেওয়ারিশ লাশ কমে আসুক। কেননা যে স্বজন প্রিয় মানুষকে হারায় আবার তার লাশটাও পায় না, এর চেয়ে আর কী দুঃখ থাকতে পারে! আবুল বাশার বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে এমনও হয়েছে যে ছেলে বাপের সঙ্গে লাশের গাড়িতে ওঠে না। তারা যায় বিমানে কিংবা আলাদা এসি গাড়িতে। ধারেকাছেও আসে না অনেকে। এসব ঘটনায় এই দুনিয়ায় কেউ কারো না, এইড্যা আমি এক্কেবারে সত্য প্রমাণ পাইছি। মারা যাওয়ার পর সবার ভাগ্যে মাটি আছে কি না, এটা কেউ জানে না। তাই কারো এমন করা উচিত না।’
বাশার বলেন, ‘কাজ করতে গেলে মাঝেমধ্যে ভাবি, আমি টানি কত লাশ! কে টানবে আমার লাশ, একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। কবরে মাটি হবে কি না, তা-ও ওপরওয়ালা জানেন।’
বাশারের দুই ছেলে। বড় ছেলের বয়স পাঁচ বছর। তাঁকে মাদরাসায় পড়ানোর ইচ্ছা বাশারের আর ছোট ছেলেকে স্কুলে। শুরুতে লাশ টানার কাজে স্ত্রীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন একটু ভয় পেলেও পরে তাঁরা অনুধাবন করেন, এটা তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে। স্বল্প বেতনের চাকরি হলেও লাশের স্বজনদের দেওয়া বকশিশে চলে যাচ্ছে তাঁর জীবন। লাশ টানার কাজে এসে দুনিয়ার মোহ খুব বেশি টানে না বাশারকে।