সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর নৃশংসতা থেকে পালিয়ে আসা মানুষরা এখন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে। এল-ফাশের শহরটি আরএসএফের দখলে যাওয়ার পর ধর্ষণ, মুক্তিপণ আদায় ও গণহত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। হাজারো মানুষ এখনো নিখোঁজ, আর যারা পালাতে পেরেছেন, তাঁরা মানবিক সাহায্যের আশায় আশ্রয় নিয়েছেন তাবিলা এলাকায়।
গত রোববার (২৬ অক্টোবর) উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহরটি সুদানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে দখল নেয় আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফ। শহর দখলের পরপরই বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ব্যাপক নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ঘটনাটিকে “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” হিসেবে বর্ণনা করেছে। আরএসএফের সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
এল-ফাশের দখলের পর যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁদের বর্ণনায় উঠে আসছে রক্তাক্ত দৃশ্য। আলখেইর ইসমাইল, এক তরুণ, দারফুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসে জানান, “রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর সময় আরএসএফ প্রায় ৩০০ জনকে আটক করে। আমি সেই দলের অংশ ছিলাম। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিচিত ব্যক্তির অনুরোধে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্য সবাইকে হত্যা করা হয়।”
অন্যদিকে, তাহানি হাসান নামের এক নারী বলেন, “হঠাৎ করেই তারা হাজির হয়। আরএসএফের পোশাকে তিন তরুণ এসে আকাশে গুলি ছুড়ে বলে ‘থামো’। এরপর তারা আমাদের বেধড়ক মারধর করে এবং পোশাক ছুড়ে ফেলে দেয়। আমি নারী হয়েও তল্লাশির শিকার হই।” ফাতিমা আবদুলরহিম, যিনি তাঁর নাতি-নাতনিদের নিয়ে তাবিলায় পৌঁছেছেন, বলেন, “তারা ছেলেশিশুদের মারধর করে, সব সম্পদ লুটে নেয়। আমাদের কিছুই রাখেনি। শুনেছি, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে।” এক তরুণী রাওয়া আবদাল্লা জানান, তাঁর বাবা এখনো নিখোঁজ। অনেকের মতোই তিনিও জানেন না, তাঁর প্রিয়জনেরা বেঁচে আছেন কি না।
আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেদতি) বুধবার রাতে এক ভাষণে বলেন, তাঁর বাহিনী সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার এই প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আরএসএফের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসব অভিযোগকে “গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন” বলে দাবি করেছেন, যা সেনাবাহিনীর পরাজয় ঢাকতে প্রচার করা হচ্ছে বলে তাঁর অভিযোগ।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, শুধু রোববার থেকে বুধবারের মধ্যে ৬২ হাজারের বেশি মানুষ এল-ফাশের থেকে পালিয়েছে। সংঘাতের শুরু ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষ, কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
চিকিৎসা সহায়তাবিষয়ক সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) জানিয়েছে, পালিয়ে আসা লোকজনের কাছ থেকে তাঁরা শুনেছেন—আরএসএফ যোদ্ধারা নারী, পুরুষ ও শিশুদের আলাদা করে আটক করে, মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়ে, আর অনেককেই হত্যা করে। মুক্তিপণ আদায় করা হয় ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি সুদানি পাউন্ড (প্রায় ৮ থেকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার)।
একজন বেঁচে থাকা ব্যক্তি বলেছেন, “আরএসএফের সেনারা বন্দীদের গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করেছিল।” অন্য একজন ২৬ বছর বয়সী নারী জানান, তাঁর স্বামী সন্তানদের বাঁচাতে মুক্তিপণ দেন, কিন্তু পরে তাঁর সামনেই তাঁকে হত্যা করা হয়। এক ১৯ বছর বয়সী তরুণী বলেন, “আমাকে ধর্ষণ করা হয়, তার আগে জানতে চাওয়া হয়েছিল আমি কুমারী কি না।”
জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, দারফুরের পাশাপাশি উত্তর করদোফান এলাকাতেও সহিংসতা ছড়িয়েছে। গত সপ্তাহে আরএসএফ বারা শহর দখল করে নেয়, যার ফলে ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ পালিয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা, ধর্ষণ ও রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবীদের বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগও উঠেছে। সুদান ডক্টরস নেটওয়ার্কের মুখপাত্র মোহাম্মদ এলশেখ বলেন, “বারা থেকে পালানো মানুষদের অবস্থা ভয়াবহ। তারা মরুভূমি, প্রচণ্ড গরম আর ঠান্ডা অতিক্রম করে এল-ওবেইদে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।” তথ্যসূত্র : রয়টার্স, আল–জাজিরা
